রুমেলা দাসঃ
২০০৪,বিকেল ৫টা ৩০মিনিট
(সমীর স্যারের কোচিন)
“কি হলো আর কতক্ষন নিয়ে বসে থাকবে?”
“আর একটু স্যার!”
“প্রি-টেস্টে ওই একটুতেই আটকে থাকবে তুমি!প্র্যাকটিস ছাড়া কি অঙ্ক হয়! ইতিহাস,ভূগোল নিয়ে বসে থাকলে আর পাশ করতে হচ্ছেনা।”
ক্যা….. আ….চ…চ্…চ্…..(সশব্দে সাইকেলের ব্রেক)
স্যারের কথাগুলো শরতের ছেঁড়া মেঘের মতো উড়ে বেড়াতে শুরু করে ‘মূর্তি’-র মন জুড়ে।অঙ্ক, স্যার, বকুনির তেতো ভাব উধাও হয়ে রঙিন রাংতার মোড়ক পড়ায় পনেরো বছরের কিশোরীর ম্যাথামেটিকস-এ।
ডিং-ডং(বেলের শব্দ)
“রঞ্জন যা তো দরজাটা খোল।নবাব বাদশা এসেছেন।”(স্যারের হুকুম পালন করতে রঞ্জন এগোলো ফ্ল্যাটের দরজার দিকে)
“এই যে,আসার সময় হলো!কটা বাজে দেখেছিস?”
“আরে মামা,স্কুল থেকে ফিরতে লেট হয়েও গেল যে।”
“তুই ভাবিস না যে,ভাগ্নে হবার সুযোগে যখন তখন আস্তে পারবি।সবকিছুরই একটা সীমা আছে।এদিকে তোর মা চিন্তায় রোজ আমাকে ফোন করে।”
ব্যাগটা রেখে স্নেহ,মূর্তির দিকে তাকালো আড়চোখে।ও জানে মূর্তি ওকে এভাবে সামনা-সামনি দেখবে না।কিন্তু দু-আঙুলের মাঝে ধরা পেনটা যেভাবে একই জায়গায় সার্কেল করে চলেছে,তাতে বুঝতে অসুবিধা হয়না যে অঙ্কটা শেষমেষ,শেষ কোথায় হচ্ছে!
“স্যার, হয়ে গেছে।”(মূর্তি,খাতাটা এগিয়ে দিলো সমীরবাবুর দিকে)
“হয়ে যে কতটা গেছে তা তো বুঝতে পারছি।আমি হলফ করে বলতে পারি,চারটের মধ্যে অন্ততঃ একটা ঠিক হবে তো!যা সময় নিলে!”
স্যারের কাছে আত্মবিশ্বাসের লেভেল খুব একটা হাই দেখাতে না পারলেও মূর্তি বোঝে আজকাল ও নিজের কাছেই নিজে বড্ড অপরিচিত হয়ে উঠছে।ভুল ভাবনারা প্রশ্রয় পেয়ে আরো ভুল ঘটাচ্ছে দিনে রাতে।একটা দুরন্ত সময় ব্রেক কষলেও মনের লাগামে কিছুতেই ব্রেক দেওয়া সম্ভব হয়ে উঠছে না।পাগলপন, অনুভূতির সিলেবাসের বাইরে তৈরি করছে আরো নতুন সিলেবাস।
২০১৫,সন্ধ্যে ৭টা
ডিং-ডং(বেলের শব্দ)
“আরে স্নেহ,আয় আয়।তোর মামী কখন থেকে তোর অপেক্ষায় বসে আছে।আজ আমাদের স্নেহের বউ আসছে বলে কথা!”
দীপ্তি আর স্নেহ গা-ঘেঁষাঘেঁষি করে বসার ঘরে ঢুকলো।ইদানিং বিয়ে হওয়ার আগে হবু বউ আর বরের দু-পক্ষের সকলের সাথে পরিচিতিটা বাধ্যতামূলক হয়ে ওঠায় রবিবারের দুপুরের ভোজনের আয়োজন,স্নেহের মামার বাড়িতে।
“আরে এত লজ্জা পাচ্ছো কেন?রান্না ঘরে তোমার মামী আছে যাও!”
দীপ্তি সলজ্জ পায়ে রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে গেল।
“কি ভাগ্না,সাদিকা লাড্ডু খেতে হবে তো!খুব যে বলেছিলিস বিয়ে করবিনা!একেবারে ডুবে ডুবে জল খেয়ে গোটা ৫বছর কাটিয়ে দিলি!আমরা কিছু টেরই পেলাম না বল!”
“ধুস,ছাড়তো।”
“ছাড়বো কি।যাই হোক,তোর মা একটু শান্তি পাবে,যা চিন্তায় থাকতো!”
“এগুলো কি মামা?”-(টেবিলের উপর রাখা কতগুলো পুরোনো অ্যালবামের দিকে চোখ পড়লো স্নেহ-র)
“তোদের দেখাবো বলে বের করে রেখেছি।বহু যুগের সব ছবি।প্রথম কোডাক কিনেছিলাম কিনা!তাই শখ।যেখানে যা পেয়েছি তুলেছি,তখন বল্টুও খুব ছোট।”
“দেখি,দেখি।”
কোনোটা সাদা-কালো কোনোটা আবার রঙিন এলোমেলো মামার শখ পূরণ করেছে।অবয়বের বেঁকা টেরা,কেঁপে যাওয়া দেখে সহজেই তা বোঝা যাচ্ছে।বিল্টুর গামলায় বসে স্নান…উফফ এই আদিম লগ্নের ছবি কেন যে সবাই তোলে!
বোঝেনা স্নেহ।
পরের পাতা ওল্টালো।
এটা কে?বিল্টুকে কোলে নিয়ে? মূর্তি না!মূর্তি চৌধুরী!সেই ছোট্ট করে কাটা চুল।নিতান্ত বোকা অথচ সুগভীর কালো চোখ আর সেই গজ দাঁতের হাসি!
স্নেহ চুপচাপ দেখতে থাকলো ছবিটার দিকে।ছেঁড়া স্মৃতিগুলো ডোরবেল বাজাচ্ছে এক এক করে।ওর মনে পড়লো একটা বিকেলের কথা।
অনেকগুলো বিকেলের কথা!
দু-দিন পর
নেট কানেকশন অন করতেই একের পর এক মেসেজ ঢুকতে শুরু করেছে।অধিকাংশই স্কুলের বান্ধবীদের।সুস্মিতা এই কিছুদিন হলো একটা স্কুলের গ্রূপে এড করেছে।যদিও খুব একটা ভাললাগেনা।তবু ব্যাঙ্গালোরে শিফট হবার পর থেকে ইচ্ছে করে যে সমস্ত মানুষের সাথে কোনোদিন আলাপ ছিল,আবার নতুন করে তাদের সাথে আলাপ করতে।অনুপও কথা কম বলে,শোনেও খুব কম।বিশ্বাসটুকু আছে যদিও।তাই মূর্তিকে বকবক করতে বাধা দেয়না।তারউপর আলাদা সংসার হওয়ায় ঘরে বাইরে এখন মূর্তির দাপুটেয়ানা সপ্রতিভ।
ফোনের এলার্ম রিং
আবার কে মেসেজ পাঠালো?
ফ্রেইএন্ড রিকোয়েস্ট!
বাবা কে এই হনু?তাও আবার ফুটবল প্লেয়ার।(প্রোফাইল পিকচারে হাফ-প্যান্ট পড়া এক যুবকের ছবি)
নাম পিকে।
কি চ্যাংড়া রে! (স্ক্রিন সরাতেই আবার মেসেজ।এবার ইনবক্সে)
“একসেপ্ট করো তাড়াতাড়ি।”
“মানে! চেনা নেই,জানা নেই,একসেপ্ট করো।মামদোবাজি নাকি!”
মূর্তি প্রোফাইল খুলে about এ গেলো।কে না কে মেয়ের ছবি দেখে রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছে-
একের পর এক ভেসে উঠলো স্ক্রিনের কালো অক্ষর-
স্নেহ ব্যানার্জী
স্কুল- আর্য বিদ্যামন্দির।
কলেজ- আই আই টি খড়গপুর।
বর্তমান- টাটা টেলকো ডিপার্টমেন্ট।
মূর্তির চোখ দুটো ফোঁটাদের মিছিলে ভরে গেল।সামনের অক্ষরগুলো কেমন যেন ঝাপসা লাগছে।জানলার ওপারের গাছটায় দুটো চন্দনা বসে।হয়তো অনেক বছর পরে ওদের দেখা হয়েছে।
২০১৬,সন্ধ্যে ৬টা
“ব্যস্ত?”
“না না”
“তুমি কি করছো?”
“আমি এই মিটিং শেষ করে এলাম।এবার একটু হালকা।কিছু বলবে?”
“তেমন কিছু না।”
“আরে বলো না।ডোন্ট বি শাই।”
“আসলে আমাদের আবার আলাপটা বড় অদ্ভুত তাই না!”
“তবে সবটাই কিন্তু আমার ক্রেডিট।ওভাবে আমি যদি তোমাকে রিকোয়েস্ট না পাঠাতাম।তোমার হয়তো আমার নামটাও মনে ছিলোনা।”😊😊(স্নেহ স্ট্রেইট লিখলো)
“একেবারে মিথ্যে তা বলবো না।তবুও সে সন্ধ্যে গুলোর প্রতিটা ঘন্টা,মিনিট,সেকেন্ড আমার আজও……”
“তুমি কিন্তু খুব কাঁচা ছিলে হিসাবে!”😊(আবারও স্মাইলি)
“এখন উল্টোটা হয়েছি।আফটার অল সমাজ শিখিয়েছে হিসাব কষতে।”
“সেটা হওয়াও উচিত”।
“আচ্ছা তোমার মন খারাপ করেনি কোনোদিন আমার জন্য।”
“করেছে তো!কিন্তু সেসময় ল্যান্ডফোন আর কেরিয়ার গড়ার দৌড়টাই বেশি প্রাইরিটি পেয়েছিল মূর্তি।তার উপর বাবা মারা যাওয়ার পর মাকে দেখার দায়িত্বটা বেড়ে যায়।”
“কতদিন পর আমার নাম ধরে ডাকলে।”
“সত্যি অবাক লাগছে,সেদিনের সেই বেহিসাবি মেয়েটা সংসার করছে।”
“তবে রিয়েলি তোমাকে ওভাবে হাফপ্যান্ট পড়া প্রোফাইলে দেখবো এটা অনাক্সপেক্টেড।”
“😊😊ওটা অফিস টুর্নামেন্টে জিতেছিলাম।বড্ড ফুটবল পাগল আমি।সবই সময়।এখন আমাদের দুজনের কাছে অন্য অনেক কিছু গুরুত্বপূর্ণ।সেদিন মামার অ্যালবামে তোমার ছবিটা দেখার পর তন্ন তন্ন করে খুঁজেছি ফেসবুক,ঠিক কি ভুল ভাবিনি।একটা অনুভূতি শুধু বলেছে,পৃথিবীটা গোল।তাই হয়তো এভাবে আবার ও”
“পাশে থেকো।সবটুকু হারালেও বন্ধুত্ব বড় জরুরি স্নেহ।অপরিণত অনেক কিছু সাহস না পেলেও পরিণত বন্ধুত্বটুকু সব কিছুর ঊর্ধ্বে।”
(মূর্তি আর স্নেহ হয়তো পাশাপাশি বসে অঙ্ক করতে পারবে না,বিকালের ঘড়ির কাঁটার দিকে চেয়ে থাকতে পারবেনা, কিন্তু ছুঁয়ে থাকার আশ্বাসে গড়ে তুলতে পারবে এমন একটা সম্পর্ক যাকে কখনো ডিলিট করা যায় না,অ্যালবাম হয়তো আমাদের এভাবেই মিলিয়ে দেয়,বাঁচিয়ে রাখে।)
Be the first to comment