আঁকিয়ে

Spread the love

মৌ দাশগুপ্তঃ

মে মাস। আকাশে কাঠফাটা রোদ্দুর। একটু ঝড়বৃষ্টি র দেখা সাক্ষাত নেই।সমান্তালে চলছে পাওয়ার কাটের ঝামেলা।নেহাত কলেজে যেতে হচ্ছেনা বলে বাঁচোয়া। মাইহারের বাংগালী ক্লাবের দরজা জানলা বন্ধ করে দিয়ে ফ্যান কুলার সব ফুলস্পীডে চালিয়ে দিয়ে আড্ডা মারছে গুটিকয়েক প্রবাসী বাঙ্গালী তরুন। আলোচ্য বিষয় আগামী মাসের গোড়ায় ক্লাবের তরফ থেকে যে প্রথামাফিক রবীন্দ্র নজরুল সন্ধ্যার আয়োজন করা হবে তাতে কি কি করা যেতে পারে, কে কি করবে, কাকে কাকে নেওয়া হবে, আমন্ত্রিত শিল্পী করে কাদের আনা হবে, ফাইন্যান্সের-ই বা কি খবর, ইত্যাদি ইত্যাদি। সাথে গ্যাটিস হয়ে। আই পি এল, রিয়েল মাদ্রিদ বার্সিলোনা, বাহুবলি, বিসর্জন, বেগমজান থেকে কলেজের নিউ হার্টথ্রব শিল্পার নতুন বয়ফ্রেন্ড, স্লীমনাবাদের মার্বেল খাদানের পরপর রহস্যজনক খুন সব প্রসংগই আসছে যাচ্ছে।সাথে ক্যারম পেটা, তাস খেলাও চলছে কিন্তু যা গরম কিছুতেই ঠিক মন বসছেনা।

এমন সময়ে বিট্টু এক্কেবারেহন্তদন্ত হয়ে এসে হাজির, বেচারা ঘেমে একশা, রীতিমত হাঁপাচ্ছে।

কি রে শালা তুই কোত্থেকে এভাবে দৌড়ে এলি?

পাগলা কুত্তা তেড়ে এসেছে বোধহয়

নারে রিনি নির্ঘাত ঐ ব্যাটা ঝিন্দোয়ানির বাচ্চাকে লব ইউ বলে দিয়েছে

আরে দূর, থাম তো। ওকেই বলতে দেনা।

বিট্টু কোনকথা না বলে আগে টেবিলে রাখা জলের বোতল থেকে ঢকঢক করে জলটল খেয়ে শ্বাস ছেড়ে ধপ করে বসে পড়ল। তারপর চোখ গোল করে বন্ধুদের দিকে তাকিয়ে বল্ল

শুনলে বিশ্বাস করবি না এমন একটা কথা বলতে পারি।বলব?

এই বিট্টু শোন এমনিতেই ভেজা গরম তার ওপর তোর ওই মার্কামারা রিপ্লের আজব খবর ঝাড়িস না তো।

মা শারদার দিব্যি, নিজের চোখে দেখে এলাম

কি দেখলি?

আমার ছোটদাদুর গুরুভাই এসেছেন পন্ডিচেরী থেকে। দারুন নাকি ছবি আঁকেন

তাতে হয়েছে টাকি?

আরে নাহ, উনি ভবিষ্যতের ছবিও আঁকতে পারেন

শালার ঢপবাজি স্টার্ট হল

ভবিষ্যত কেমন দেখতে রে? কটা লেজ? শিং আছে? গরুর মত শিং নাকি হরিণের মত?

আরে তোরা বুঝতে পারছিস না, তোকে দেখে আজ থেকে ১০ বা ২০ বছর পর তুই কি রকম দেখতে হবি সেটা উনি একে দিতে পারেন।

হ্যাঁ সে তো পারবেন ই। তোরা শালা হোল ফ্যামিলি ঢপবাজ। আমাদের হাতে তো টাইম মেশিন নেই যে মিলিয়ে দেখব। চুপ মার।ব্যাটা দিল সব গুলিয়ে।

এই মায়ের দিব্যি, এই চোখ ছুঁয়ে বলছি। অন্যদের ককথা চছাড়, উনি কুড়ি বছর আগে এই বাড়িতে এসে আমার বাবার যে ছবি এঁকে দিয়েছিলেন বা ছোটদিদুনের তা একদম মিলে গেছে।

যা তালে তোর নিজের ছবি আঁকিয়ে নে

একটু ইত:স্তত করে বিট্টু বল্ল, আমিও তোদের মত বিশ্বাস করিনি প্রথমে কিন্তু ছোটদাদু আজ আলমারি থেকে যখন বাবা আর ছোট দিদুনের হাতে আঁকা ছবি বার করে দেখালো তখন বিশ্বাস কর, গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠেছিল। মাইরি বলছি, হুবহু এক। বিশ্বাস না হয়, চল তোরা নিজের চোখে দেখে আসবি।

বিশ্বাস হোক না হোক বিট্টুর ইনফর্মেশন কতটা সঠিক দেখতে ক্লাবে রিপ্রেসেন্টেটিভ হয়ে নক্ষত্র, প্রীতম, আনন্দ আর শিবা গুটিগুটি পরদিন বিকেলে পায়ে হাজির হল ওদের বাড়ি।কেননা বিট্টুর ছোটদাদূর গুরুভাই মাত্র তিনদিনের জন্য এসেছেন।আগামীকাল মাইহারের মা শারদা মন্দিরে পুজো দিয়ে ফেরত যাবেন।

সাদা পায়জামা পাঞ্জাবি পরা মাঝারি হাইটের রোগাভোগা ভদ্রলোক।মাথার সাদা চুল উলটে ব্যাকব্রাশ করা।আপাতদৃষ্টইতে কোন বিশেষত্ব নেই। বাইরের ঘরে বসে বিট্টুর দাদু ছোটদাদু আর স্থানীয় সৎসংগ আশ্রমের জনাকয়েক গুরুভাইয়ের বিকালের চা নিমকির আড্ডা চলছিল।বিট্টু ওর বন্ধুদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে যখন উনি তাকালেন তখন বোঝা গেল বিশেষত্বটা কোথায়। ওনার চোখে। অসম্ভব উজ্জ্বল চোখ। চোখে চোখ রেখে তাকিয়ে থাকা যায় না বেশিক্ষণ।

প্রথমে গররাজি হলেও পরে সবার বারবার অনুরোধে সদানন্দবাবু মানে বিট্টুর ছোটদাদুর আর্টিস্ট বন্ধু পোট্রেট আঁকতে রাজি হলেন। প্রথম মডেল আনন্দ। ২৬ ইঞ্চি ছাতি, সলমন খানের আদলে হেয়ার স্টাইলয়ালা আনন্দ নাকি ভবিষ্যতে টেকো ভুঁড়িয়াল হয়ে যাবে। আর বিট্টুর চোখে চশমা, কপালে গভীর একটা কাটা দাগ, চুল পাকা হলেও সেই ক্ষয়াটে খর্বুটে মার্কা চেহারাই থাকবে। একঘন্টার মধ্যে দুজনের সিটিং শেষ। এরপর শিবার পালা। শিবা সিটিং দিতে জানলার সামনের নির্দিষ্ট চেয়ারে বসতেই কেমন উশখুশ করতে শুরু করলেন সদানন্দবাবু। কাগজ পেন্সিল সরিয়ে রেখে চুরুট ধরালেন একটা। পোড়া তামাকের গন্ধটা ছড়িয়ে পড়ল ঘরে। এক্টার পর আরেকটা। হাত কাঁপছে ওনার। চুরুট টাও ধরাতে পারছেন না। ঘামছেন। শেষে বললেন,

দ্যাখও ভাই, আমি তো আর আর পেশাদার আঁকিয়ে নই। এক আধটা ছবি আঁকি তাও কালেভদ্রে শখ করে। আজ সকাল থেকে চারটে ছবি এঁকে ফেলেছি তো আর মাইন্ড সেট করতে পারছি না। আমি বরঞ্চ তোমার এখনকার ছবিই এঁকে দিই।

না দাদু, ব্যস্ত হবেন না। আপনি রেস্ট নিন। আমরা না হয় কাল আপনি বেরোনোর আগে একবার আসব।

সেই ভালো ভাই। কালই এসো। আজ বড় ক্লান্ত লাগছে। একটু উঠছি। কিছু মনে কোর না কেমন?

ট্রেনের ফার্স্টক্লাস এ সি কামরার শীতলতাতেও বয়স্ক ভদ্রলোকের কপালে ঘাম জমেছে। সাদা পাঞ্জাবিটাও ভিজে উঠেছে কয়েক জায়গায়।চোখেমুখে জল দিয়ে আসতে ওয়াশ রুমের দিকে পা বাড়ালেন। সীটের ওপর পড়ে রইল চারকোল পেন্সিল চাপা দেওয়া একটুকরো কাগজ, একটি অল্পবয়সী ছেলে, চোখ বন্ধ, কপালে চন্দনের ফোঁটা। হাতে আঁকা ছবিতেও সারা মুখে মৃত্যুর হিমশীতলতা।শিবার সাথে ও মুখের একটুও তফাত নেই।

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*