‘ছোট্ট জিজ্ঞাসা’ দিয়ে শুরু, তারপর শিশু শিল্পী হিসেবে পথ চলা ‘রাহাগির’, ‘রক্ততিলক’ হয়ে ‘দুই পৃথিবী’তে। জন্ম ১৯৬২ সালের ৩০শে সেপ্টেম্বর, ১৯৬৮তে ফিল্মে হাতেখড়ি। তখন থেকে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত শিশু শিল্পী হিসাবে নিজের জাত চেনান ছোট্ট বুম্বা।
১৯৮১তে ‘প্রতিশোধ’ সুখেন দাসের পরিচালনায়, ৮২তে ‘অপরুপা’(পরিচালক বিদেশ সরকার)। ১৯৮৩তে বিমল রায়ের ‘দুটি পাতা’ ছবিকেই নায়ক প্রসেনজিতের টলিউডের ড্যেবু ছবি হিসাবে ধরা হয়।
যদিও ‘দুটি পাতা’ বানিজ্যিক ভাবে তেমন সফল হয়নি। সমালোচকদের প্রশংসাও ততটা পায়নি। কিন্তু হাল ছাড়েননি বুম্বা। একের পর এক ‘অগ্রদানি’, ‘জীবন-মরণ’, ‘দাদামণি’, ‘শত্রু’, ‘সোনার সংসার’, ‘নীলকন্ঠ’, ‘তিল থেকে তাল’ চার বছরে(১৯৮১-১৯৮৫)দশটা ছবি করেন।
এর পরের ঘটনা ইতিহাসে। একের পর এক হিট ছবি- বক্স অফিসে সাফল্য। ১৯৮৬-১৯৯০ চার বছরে রেকর্ড সংখ্যক ছবি করেন প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়। মোট ৫১টি ছবি। তার মধ্যে ১৯৮৭ তে ‘অমর সঙ্গী’ সুপার-ডুপার হিট হয়। নায়িকা বিজয়েতা পন্ডিত ও প্রসেনজিতের ডুয়েট লিপে ‘চিরদিনই তুমি যে আমার যুগে যুগে আমি তোমারই সঙ্গী-অমর সঙ্গী’, তখন প্রায় বাংলার বিশেষত গ্রাম বাংলার জাতীয় সঙ্গীত।
ইচ্ছে করেই গ্রাম বাংলার কথাটা ব্যবহার করলাম। কারণ কলকাতার এলিট সমাজ তখন বিদ্রুপ করতো প্রসেনজিতকে। ‘ছোট বৌ’, ‘শুধু তোমারই’ ‘আশা ও ভালোবাসা’, ‘আমার তুমি’, ‘আক্রোশ’, ‘ঝংকার’, ‘প্রণাম তোমায়’, ‘আমানত’, ‘আলিঙ্গন’, ‘মন্দিরা’, ‘ভাঙাগড়া’, ‘লড়াই’ প্রভৃতি বিভিন্ন ছবিতে তখন অপ্রতিরোধ্য প্রসেনজিত। একাই প্রায় টলিউডের মাসিহা। অবশ্য শহুরে তথাকথিত আধুনিকদের দেওয়া একটা নতুন নাম হয়েছে তাঁর “পোয়েনজিৎ”।
এর মধ্যেই(৮৬-৯৬) তপন সিনহার ‘আতংক’, তরুন মজুমদারের ‘পথ ভোলা’, পরিমল রায়ের ‘সম্রাট ও সুন্দরী’, অগ্রদূতের ‘অপহরাহ্নের আলো’, ডেভিড ধাওয়ানের হিন্দি ছবি ‘আঁধিয়া’(প্রথম হিন্দি ছবি)তে তিনি বিভিন্ন ভূমিকায় অভিনয় করে প্রমাণ করেছেন তাঁর ভারসাটাইল দক্ষতা।
বিশিষ্ট সমালোচকদের চোখে তখনও তিনি ব্রাত্য। আমাদের তখন সদ্য কৈশোর। আমরাও বেশির ভাগ নাক সিঁটকাতাম প্রসেনজিতের কথা উঠলে।
কিন্তু বাংলা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিকে এই পিরিয়ডে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন একজনই। তিনি হলেন প্রসেনজিৎ ওরফে বুম্বা। তাঁর একের পর এক কমার্শিয়াল হিট ছবি ইন্ডাস্ট্রির পেটে ভাত জুগিয়েছে। নাই বা হলো উচ্চমানের ছবি। এই ছবিগুলোতে কাজ করে শিল্পী কলাকুশলীরা খেয়ে পড়ে বেঁচেছেন। পাশাপাশি গ্রামীন বাংলা যেখানে নন্দন নেই, EZCC নেই, নেই মাল্টিপ্লেক্স, সেইসব এলাকার দর্শকরা মুগ্ধ হয়েছেন বুম্বার ছবি দেখে। করেছেন প্রাণ ভোরে আশীর্বাদ। ১৯৯১-৯৫ চার বছরে ছত্রিশটা ছবি, ১৯৯৬ থেকে ২০০০ নিজের রেকর্ড ভেঙে আবার রেকর্ড ৫৯টি ছবি।
রবীন্দ্রনাথ যখন একের পর এক সৃষ্টিতে মগ্ন তখন অন্য কবিরাও ভালো লিখেছেন, কিন্তু রবি কবির প্রচন্ড আলোক ছটায় তাঁরা হারিয়ে যান।
এই সময়ও মূলধারার ছবিতে তাপস পাল, চিরঞ্জিৎ, অর্জুন চক্রবর্তী, অভিষেক এঁরা ভালো কাজ করেছেন, কিন্তু বুম্বার ধারে কাছে কেউ যেতে পারেননি। এরই মাঝে আমাদের স্কুল বেলায় দেখলাম ঋতুপর্ণ ঘোষের ‘উনিশে এপ্রিল’, দেবশ্রী ও অপর্না সেনের অসাধারন অভিনয়। দেবশ্রী পেলেন জাতীয় পুরস্কার, কিন্তু অল্প সুযোগ পেয়েও ঝিলিক দিয়ে গেলেন বুম্বা। বুঝিয়ে দিলেন yes I can.
২০০১-২০০৫ আবারও ৫৩টি ছবি, ২০০৬-২০১০ ৩৬টি।
২০১১- বাংলার রাজনৈতিক তথা প্রশাসনিক পালা বদল হলো। বলা হয় পরিবর্তন এল। কাকতালীয় নাকি যুক্তিযুক্ত বলতে পারবো না, বাংলা ছবির জগতেও এল পরির্বতন। একঝাঁক তরুণ ফিল্ম যোদ্ধা, পরিচালক ছবি তৈরীতে হাত দিলেন বাংলায়। ঋতুপর্ন ঘোষ তখন তাঁর প্রিয় জুঁইফুল দিয়ে ছবির মালা গাঁথছেন। আর প্রসেনজিৎ যেন তাঁর সৌরভ। ২০০১এ ঋতুপর্নর পরিচালনায় ‘উৎসব’। ২০০৬-এ ‘দোসর’। ২০০৭-এ ‘দ্য লাস্ট লিয়ার’ একের পর এক ছবিতে তাঁর মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন প্রসেনজিৎ। কিন্তু পাশাপাশি চালিয়ে গেছেন বাংলার কমার্শিয়াল ছবিগুলো। একটু অন্য ধারার ছবির মধ্যে ২০০৯-এ ‘হাউসফুল’, ২০১০-এ ‘মনের মানুষ’, ‘অটোগ্রাফ’, ‘তারা’, ‘ক্লার্ক’, ২০১১-এ ‘নৌকাডুবি’, ‘কসমাকস’, ‘বাইশে শ্রাবণ’, ২০১২তে ‘অপরাজিত তুমি’, ২০১৩ তে ‘মিশর রহস্য’, ২০১৪ তে ‘জাতিস্মর, ২০১৫ তে ‘লড়াই’, ২০১৬ তে ‘ক্ষত’, ‘প্রাক্তন’, ‘জুলফিকার’, ‘শঙ্খচিল’, ২০১৭ তে ‘ওয়ান’, ‘ইয়েতি অভিযান’, ‘ককপিট’, ‘ময়ূরাক্ষী’, আসছে কৌশিক গাঙ্গুলীর ‘দৃষ্টিকোণ’, ‘মহাভারত’ ‘3-দেব’। পরিচালক হিসাবেও দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। ১৯৯৮ তে ‘আমি সেই মেয়ে’, প্রযোজক হিসাবেও ইন্ডাস্ট্রির সুনাম বৃদ্ধি করেছেন। ‘দ্যাখ কেমন লাগে’, ‘বাপি বাড়ি যা’, ‘জন্মদাতা’, ‘পুরষোত্তম’ প্রভৃতি ছবি গুলিও তাঁরই প্রযোজনায় তৈরী।
এত জনপ্রিয়তা ও সাফল্য সত্ত্বেও টেলিভিশনের জগতে পা রেখেছেন এবং সেখানেও হিট। ‘গানের ওপারে’ সিরিয়ালে মিমি, অর্জুন, গৌরবের ড্যেবু ফিল্মে অভিনয় বুম্বারই হাত ধরে। জি-বাংলায় ‘বাংলার সেরা পরিবার’ ‘তুমি যে আমার’ প্রভৃতি রিয়ালিটি শো করেন। এছাড়া ‘মহানায়ক’ বলে একটি টিভি সিরিয়ালে মহানায়কের ভূমিকায় অভিনয় করেন তিনি। এছাড়া ৫টি সিরিয়ালেও দেখা গেছে তাঁর মত বিখ্যাত চলচ্চিত্র অভিনেতাকে।
একের পর এক রেকর্ড ভেঙে তিনি প্রমাণ করেছেন বর্তমান বাংলা ছবির মহানায়ক তিনি। উত্তমকুমারে্র প্রতি শ্রদ্ধা ভালোবাসা থেকেই বলছি বুম্বা অনবদ্য। অডিও ভিসুয়াল সাংবাদিকতার প্রথম দিকে গুরু অভিজিৎ দাশগুপ্ত শিখিয়েছিলেন কিভাবে প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি এলে কভার করতে হয়। আবার এও শিখিয়েছিলেন ঘরের মধ্যে বেতের সামান্য মোড়া থেকেও কিভাবে এক্সক্লুসিভ স্টোরি করা যায়। আসলে পারফরমারের কাছে ছোট বড় বলে কিছু হয় না। এ প্রসঙ্গে জন আব্রাহামের একটি উক্তি খুব প্রযোজ্য, তা হল ‘ I still believe ‘’no smoking’’ is one of my best performance.’
বুম্বা তাঁর জীবন দিয়ে প্রমাণ করেছেন শিল্পীর কোনো ছুতমার্গ থাকে না। বিকল্প ধারা বা মূলধারা, আর্ট ফিল্ম নাকি কমার্শিয়াল সেটা বড় কথা নয় আসলে ছবির বিভাজনই করা উচিত নয়। ভালো ছবি, সেটাই হোক একমাত্র লক্ষ্য। আর সেই লক্ষ্যেই বুম্বা ভীষন ভাবে সফল। এখনকার নুতন প্রতিভাদের কাছে তিনি আদর্শ। তাই বিখ্যাত মার্কিন ফুটবলার Ralph Marston এর এই উক্তিটি দিয়ে শেষ করছি, Raise your level of performance to meet your expectation.
Be the first to comment