বারাকপুরের নামকরণেই মিশে আছে রহস্য

Spread the love
বারাকপুর। যে-জনপদটির নাম শুনলেই আমাদের মনে পড়ে যায় সিপাহি বিদ্রোহের কথা। ১৮৫৭ সালে এই বারাকপুরের সেনানিবাসেই বিদ্রোহ করেছিলেন মঙ্গল পাণ্ডে ও তাঁর সঙ্গীরা। এখানেই ফাঁসি হয়েছিল তাঁর। বলা হয়, বারাকপুর থেকেই সিপাহি বিদ্রোহের আগুন ছড়িয়ে পড়ে ভারতের সর্বত্র। কিন্তু শুধু এ-জন্যেই কি বারাকপুরের খ্যাতি? একটি প্রচলিত মত হল, ইংরেজদের সেনানিবাস বা ‘ব্যারাক’ এখানে স্থাপিত হয়েছিল বলেই জনপদটির নাম ক্রমে ‘বারাকপুর’ হয়েছে। কতটা সত্যি এই মত? বারাকপুর নামকরণের পিছনে কি অন্য কোনো কাহিনি লুকিয়ে রয়েছে? সেসব উত্তর খুঁজতেই এই লেখার দ্বারস্থ হওয়া…
বারাকপুরের আদিনাম ‘চাণক’। কোনো কোনো ঐতিহাসিক বলেন, মৌর্য পণ্ডিত চাণক্যের নামানুসারে এই অঞ্চলের নাম ‘চাণক’ হয়েছে। কিন্তু আমরা মৌর্য সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত ও তাঁর মন্ত্রী কৌটিল্য বা চাণক্যের ক্রিয়াকলাপের ক্ষেত্র হিসেবে মগধকেই জানি। বাংলার গঙ্গাতীরের সুদূর এই জনপদ হঠাৎ চাণক্যের নাম ধারণ করতে গেল কেন? আমার মনে এই যে প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে, এর উত্তর কোথাও খুঁজে পাইনি। বদলে ‘আগড়পাড়ার ইতিবৃত্ত’-এর লেখক চঞ্চল কুমার চট্টোপাধ্যায় বলেছেন, গত শতাব্দীতে নাকি এখান থেকে খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল দুটি পাথরের নিদর্শন – একটি ভগ্ন বিষ্ণুমূর্তি, অপরটি ধ্যানস্থ বুদ্ধমূর্তি। এছাড়াও পাওয়া গিয়েছিল কিছু ভাঙা মৃৎপাত্রও। বিশেষজ্ঞরা নাকি মত জানিয়েছেন, এই নিদর্শনগুলি মৌর্যযুগের। কিন্তু শুধুমাত্র এই কথা ওপর নির্ভর করে ‘চাণক্য’ থেকে ‘চাণক’ – যুক্তিগ্রাহ্যতার ইতিহাস সাজাতে পারছি না। যদি তাই হয়ও, তবু, কেন সুদূর মগধের চাণক্যের নাম এই বাংলার একটি গ্রামে এসে মিশল – এ-বিষয়ে আরও গভীর খোঁজ নেওয়া দরকার বলে মনে হয় আমার। (এ-প্রসঙ্গে একটি কৌতূহলী ইঙ্গিত খুঁজে পেলাম। চাণক্যের মূল নাম ছিল বিষ্ণুদত্ত। তৎকালীন তক্ষশীলায় জন্ম তাঁর। জন্মগ্রাম ‘চাণকা’, মতান্তরে পিতার নাম ‘চাণক’ থেকেই তিনি ‘চাণক্য’ হিসেবে পরিচিত হয়েছিলেন। এই সূত্রের সঙ্গে আমাদের উল্লিখিত চাণক-এর কি কোনো সম্পর্ক পাওয়া সম্ভব? ঐতিহাসিকরা ভাবতে পারেন একবার…)
অপর একটি কানাঘুষো শোনা যায়। জোব চার্নকের নাম থেকে নাকি গ্রামটি ‘চাণক’ হিসেবে পরিচিত হয়েছিল। এও বলা হয়, জোব চার্নক নাকি বারাকপুর স্টেশন রোডের ‘চার্নক ভিলা’-য় বসবাস করতেন। কিন্তু এসব কথা ঐতিহাসিক দিক দিয়ে সম্পূর্ণই অর্থহীন। জোব চার্নকের নাম থেকে ‘চাণক’ নাম আসেনি। কারণ, জোব চার্নকের সময়কাল সতেরো শতকের শেষার্ধ। আর, ১৪৯৫ সালে লেখা বিজয়গুপ্তের ‘পদ্মপুরাণ’-এই পাওয়া যায় চাণক গ্রামের উল্লেখ। এছাড়াও, ১৬৬০ সালে ফানডেন ব্রুকের মানচিত্রে কাঁকিনাড়া ও বরাহনগরের মধ্যিখানে ‘চাণক’ গ্রামের হদিশ পাওয়া যায়। অতএব, চাণক গ্রাম যে জোব চার্নকের আমলেরও বহু প্রাচীন – তা নিয়ে কোনো সন্দেহ থাকতে পারে না।
এখন সবচেয়ে আকর্ষণীয় প্রসঙ্গে ঢুকি। ‘চাণক’ থেকে ‘বারাকপুর’ – এই নামবদলের কারণ কী? প্রচলিত ও সহজ উত্তরটি প্রথমেই জানিয়ে রেখেছি – ১৭৭২ সালে ইংরেজরা এখানে কোম্পানির প্রধান মিলিটারি ক্যান্টনমেন্ট স্থাপন করার পর, গ্রামটির নাম ক্রমে ‘বারাকপুর’ হিসেবে পরিচিত হয়। এবং, ১৮০৫ সালে কলকাতার সঙ্গে বারাকপুরের সংযোগকারী রাস্তা হিসেবে চালু হয় ‘বারাকপুর ট্রাঙ্ক রোড’ বা বিটি রোড। এখানেই আমার সন্দেহ জাগে। ১৭৭২ সালে তৈরি হল ক্যান্টনমেন্ট, আর তার তেত্রিশ বছর পরে রাস্তা তৈরি হল ‘বারাকপুর ট্রাঙ্ক রোড’ – এত অল্প সময়ের মধ্যেই কি তাহলে প্রতিষ্ঠা পেয়ে গেল ‘বারাকপুর’ নামটি! নাকি এর পিছনে শাসক ইংরেজদের প্রতিপত্তি কাজ করছে, যে-কারণে তাদের ‘ব্যারাক’-এর সাপেক্ষে ‘বারাকপুর’-এর পরিচিতি? উঁহু, তা সম্ভব নয়। ‘ব্যারাক’ একটি ইংরেজি শব্দ। আর ‘পুর’ হল খাঁটি তৎসম। এই দুটি শব্দ হঠাৎ করে মিলে গিয়ে তিরিশ বছরের মধ্যেই প্রতিষ্ঠা পেয়ে গেল – এ-কথা মেনে নেওয়া আমার পক্ষে অসম্ভব। যদি আরও দীর্ঘ দীর্ঘ কাল কেটে যেত, সময়ের নিয়মে হয়তো মিলমিশ হয়ে যেতেও পারত – কিন্তু সময়ের সংক্ষিপ্ততাই বুঝিয়ে দিচ্ছে, ইংরেজদের ব্যারাকের কারণে ‘বারাকপুর’ হয়নি। এবং, আমরা চলতি কথায় ‘ব্যারাকপুর’ বলে বা লিখে থাকলেও, জায়গাটির আসল বানান যে ‘বারাকপুর’, তাও নিশ্চয়ই খেয়াল করেছেন এতক্ষণে।
তাহলে, ‘চাণক’ থেকে ‘বারাকপুর’ হল কীভাবে? আবার উঁকি দিই ইতিহাসে। সুলতানি আমলে, চাণক গ্রামটি ছিল সপ্তগ্রাম পরগনার অধীনে। সপ্তগ্রামের একজন শাসনকর্তা ছিলেন রুকনউদ্দিন বারবক শাহ। তিনি ছিলেন একজন সুশাসক ও বিদগ্ধ ব্যক্তি। তাঁর স্মৃতিকে অমর করে রাখতে, তাঁরই নামানুসারে চাণক গ্রামটির নামকরণ করা হয় ‘বারবকপুর’। সেই ‘বারবকপুর’-ই কালক্রমে পরিচিত হয়েছিল ‘বারাকপুর’ নামে। ১৫৮২ খ্রিষ্টাব্দে রচিত ‘আইন-ই-আকবরী’ গ্রন্থে, উল্লেখ পাওয়া যায় ‘মহাল বারাকপুর’-এর। 
অতএব, বারবকপুর থেকে বারাকপুর – এটিই প্রামাণ্য তথ্য। পরে, ওই অঞ্চলেই ইংরেজদের ব্যারাক স্থাপিত হওয়ার পর, ধ্বনিসাদৃশ্যের কারণে লোকমুখে বারাকপুর ‘ব্যারাকপুর’-এ পরিণত হয়। সম্ভবত ইংরেজরাও ‘ব্যারাকপুর’-ই উচ্চারণ করত। ইংরেজি বানান ‘Barrackpore’ থেকেই তা বোঝা যায়। কিন্তু বারাকপুরের আদি ও অকৃত্রিম নামকরণের সঙ্গে ইংরেজদের কোনো সম্পর্কই নেই – রয়েছে রুকনউদ্দিন বারবক শাহ নামক একজন ইতিহাস-বিস্মৃত শাসকের স্মৃতি।
একটি ধারণার অবসান অপর একটি সত্যকে প্রতিষ্ঠা করে – বারাকপুরই কি তার অন্যতম উদাহরণ নয়?

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*