কারও বাবা শ্রমিক, কেউ বা চায়ের দোকান চালিয়ে সংসার টানেন। এক চিলতে ঘরে দারিদ্রের ছাপ স্পষ্ট। পুষ্টিকর খাবার তো দূর, ঠিক ভাবে খাওয়া জুটলেই তাঁরা ভগবানকে ধন্যবাদ দেন। এমন ঘর থেকেই বুঝি প্রতিভার জন্ম হয়। কথায় বলে না, আগুনে পুড়লেই সোনার ঔজ্জ্বল্য বাড়ে। তাই তেতে-পুড়ে নিরন্তর অভাবের সঙ্গে লড়াই করতে করতে কিশোরীবেলাতেই সোনার স্বপ্ন ছুঁয়ে ফেলেছে তিন অগ্নিকন্যা।
রূপসা দে, শিবানী ক্ষেত্রপাল এবং নমিতা সাঁতরা— এই সোনার মেয়েদের ঘিরেই নতুন করে স্বপ্ন দেখা শুরু করেছে কোতলপুর। কেরলে তিরুঅবন্তপুরমের জিমি জর্জ ইনডোর স্টেডিয়ামে গত ১ সেপ্টেম্বর থেকে সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত হয় এগারোতম জাতীয় অ্যাক্রোবেটিক জিমন্যাস্টিকস চ্যাম্পিয়নশিপ। সেখানকারই।
ট্রায়ো ইভেন্টে স্বর্ণপদক জেতে এই তিনজন। আগামী নভেম্বরে আজারবাইজানে বিশ্ব মিটে যোগ দিতে পারবে তারা। তাই এ বার হাতে তেরঙ্গা নিয়ে বিদেশের মাটিতে জয় ঘোষণা করার পথে অগ্নিকন্যারা।
নমিতার মা বুল্টি সাঁতরা। রূপসা, নমিতা এবং শিবানী, তিনজনেরই বাড়ি কোতলপুরের প্রত্যন্ত এলাকায়। বয়স কারওর ১১, কারওর ১২। নমিতা কোতলপুরের শিরোমণিপুর জুনিয়র হাইস্কুলের সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী। বাড়িতে বাবা, মা ছাড়াও রয়েছে ছোট ভাই এবং ঠাকুমা। নমিতার বাবা পেশায় শ্রমিক। দিনমজুরি করে যা আয় হয় তাই দিয়ে পাঁচজনের পেট ভরে না। ‘‘অভাবের সংসার। মেয়ে সোনা জিতেছে এটাই আমার গর্ব,’’ চোখের জল মুছে বললেন বুল্টিদেবী। মেয়ের সাফল্য সংসারের সব অভাব ভুলিয়ে দিয়েছে তাঁকে। এখন তাঁর চোখেও আগামী দিনের স্বপ্ন।
রূপসা এবং শিবানী কোতলপুরের সরোজ বাসিনী বালিকা বিদ্যালয়ের ছাত্রী। রূপসা পড়ে ক্লাস সিক্সে, শিবানী সেভেনে। বাবা, মা ছাড়াও রূপসার পরিবারে রয়েছে তার বড় দিদি। পাড়ার মোড়ে বাবার ছোট্ট চায়ের দোকান। কষ্ট করেই দুই মেয়েকে বড় করছেন বলে জানালেন রূপসার বাবা সুবিমন দে। তাঁর কথায়, ‘‘ছ’বছর বয়স থেকে অভ্যাস করছে মেয়ে। টানাটানির সংসারে মেয়ের সঠিক পরিচর্চা হয় না। এ বার আন্তর্জাতিক স্তরে কী ভাবে ওকে পাঠাবো জানি না। সবার সহযোগিতা চাই।’’
একই কথা জানালেন শিবানীর বাবা, মাও। তার বাবা কোল্ড স্টোরেজে মজুরের কাজ করেন। গত বছরই ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে শিবানীর ছোট ভাই। তাই মেয়েকে নিয়েই এখন বাঁচার স্বপ্ন দেখে তার পরিবার।
তিন কন্যার জয়ের পথে বাধা তাদের চূড়ান্ত আর্থিক সঙ্কট। খেটে খাওয়া পরিবার বিদেশের স্বপ্ন দেখতে ভয় পায়। এমনটাই জানিয়েছেন বাঁকুড়া জেলা জিমনাস্টিক অ্যাসোসিয়েশন বিবেকানন্দ ক্লাবের প্রধান সদানন্দ ভদ্র। তিন কিশোরীর প্রশিক্ষকও তিনি। সদানন্দবাবু জানান, এই প্রতিভাকে কোনও ভাবেই থামতে দিতে নারাজ ক্লাবের সদস্য থেকে এলাকার বাসিন্দারাও। কিন্তু, বিদেশে যাওয়ার টাকা কোথায়? পাসপোর্ট, ভিসার ঝক্কি পেরিয়ে প্রতিযোগিতার জন্য বিশেষ পোশাকের খরচও অনেক। তাই মুখ্যমন্ত্রীর কাছে সাহায্যের আবেদন জানাতে চলেছেন ক্লাবের সদস্যেরা।
সদানন্দবাবুর কথায়,‘‘রাজ্য স্তরে সফল হয়ে তিনজনেই জাতীয় স্তরেও সোনা দিতে নিয়েছে। এ বার লক্ষ্যে বিদেশের মাটিতে ভারতের মুখ তুলে ধরা। তার জন্য খুবই পরিশ্রম করছে তিনটি মেয়ে। তাদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য অনুরোধ করছি সবাইকে।’’ পাশাপাশি, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছেও সাহায্যের আবেদন জানিয়েছেন তিনি।
এশিয়াডে সোনা জয়ী জলপাইগুড়ির স্বপ্না বর্মণের মতো আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় সোনা জয়ের স্বপ্ন দেখতে শুরু করে দিয়েছেন বাঁকুড়ার প্রত্যন্ত কোতুলপুর ব্লকের মানুষজন। এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা।
Be the first to comment