বাংলার শক্তি আরাধনা ও কালীপুজো

Spread the love

তপন মল্লিক চৌধুরী : বাংলায় হিন্দু ধর্ম প্রায় উবে গেছিল পাল যুগে। বৌদ্ধ পাল-রাজারা গোটা পূর্ব ভারতে নিজেদের ধর্ম সুপ্রতিষ্ঠিত করায় লোকসাধারণের ধর্মও পাল্টে যায়। তবে লক্ষ্য করার বিষয় লৌকিক দেব-দেবীর পুজো চলতে লাগল বৌদ্ধ তন্ত্রমন্ত্রেই। কালী, তারা, ভদ্রকালী, রক্ষাকালী, শ্মশানকালী, রঠন্তীকালীর পুজো এর আগে হতো লৌকিক পদ্ধতিতে। পাল যুগে চালু হলো বৌদ্ধ তন্ত্র অনুসারে। পাল-রাজাদের পতনের পর সেন-রাজাদের আমলে হিন্দু যুগ ফিরে এলে বাংলায় শক্তির আরাধনা চলতে থাকলেও তার প্রকৃতি যায় বদলে। অর্থাৎ বৌদ্ধ তন্ত্র অনুসারে আরাধনা চলে হিন্দু যুগের আচার অনুযায়ী। এরপর বখতিয়ার খিলজির বঙ্গ বিজয়ের মধ্য দিয়ে মুসলিম যুগের সূচনা হওয়ায় রাজনীতি-সমাজ-এর সঙ্গে ধর্মীয় পটও পরিবর্তিত হয়। এরকমই এক সন্ধিক্ষণে নবদ্বীপে শ্রীচৈতন্যের আবির্ভাব এবং তাঁরই হাত ধরে বাংলায় ভক্তি আন্দোলনের জোয়ার আসে। একদিকে মুসলিম আগ্রাসন, অন্যদিকে বৈষ্ণব ধর্ম—এই দুয়ের মাঝে পড়ে বাংলার সনাতন শক্তি চেতনা হয়ে পড়ে কোণঠাসা। কিন্তু এই সময়েই কালীর একক মূর্তি, যে প্রতিমা আমরা আজ দেখি এবং পুজো করি তার প্রবর্তন হয় নবদ্বীপের বিশিষ্ট শাক্ততন্ত্রশাস্ত্র পণ্ডিত কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ-এর হাতে। তিনি বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা রক্ষাকালী, শ্মশানকালী, রঠন্তীকালী প্রভৃতি লৌকিক দেবদেবী একত্রিত করে কালীর একত্র মূর্তি প্রবর্তন করলেন, একইসঙ্গে বিভিন্ন তন্ত্রের সারাংশ সম্মিলিত করে লিখলেন ‘তন্ত্রসার’ গ্রন্থ। কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশের রূপ দেওয়া কালী মূর্তি এবং পুজো পদ্ধতি সুসংহতভাবে প্রচলিত হয় নদিয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের সময়। একাধারে ঘোর বৈষ্ণব-বিরোধী এবং শক্তি আরাধক কৃষ্ণচন্দ্র তাঁর রাজত্বের বিভিন্ন জায়গায় কালী পুজোর সূচনা করেছিলেন। কিন্তু শুরুতে কালীপুজো বঙ্গের সাধারণ শিক্ষিত ও সংস্কৃতিমনস্ক মানুষের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে উঠতে পারেনি। বরং লৌকিক দেবী হওয়াতে কালী জনপ্রিয়তা অর্জন করে মূলত অন্ত্যজ বর্ণের মধ্যে। অন্যদিকে আগমবাগীশ ব্রাহ্মণ হলেও ছিলেন তান্ত্রিক গোষ্ঠীর সাধক। তাই তাঁর কালীপুজোর পদ্ধতি গ্রহণযোগ্য হয় তান্ত্রিক কালীসাধকদের মধ্যে। আর কৃষ্ণচন্দ্র প্রবর্তিত কালীপুজো প্রাথমিকভাবে সীমাবদ্ধ ছিল তৎকালীন সমাজের তথাকথিত উচ্চবর্ণ এবং অভিজাত শ্রেণির মধ্যে।

পাড়ায় পাড়ায় মণ্ডপ তৈরি করে কালীপুজোর শুরু এবং তার জনপ্রিয়তা এর বহু পরে। আমরা জানি ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের একটা পর্বে অনেক বিপ্লবী কালীকে শক্তির রূপক মনে করে পুজো করতেন। বাংলার বিপ্লববাদের প্রবক্তা অরবিন্দ ঘোষ ও তাঁর ভাই বারীন্দ্রনাথ ঘোষ তাঁদের গোপন ডেরায় কালীর ছবি রেখে পুজো করতেন এবং সেই ছবির সামনে দাঁড় করিয়ে নবীন বিপ্লবীকে শপথ করাতেন, শক্তিমন্ত্রে দীক্ষা দিতেন। বাংলার শক্তিসাধনার সর্বেশ্বরী কালিকাকে এই পর্বে আমরা স্বচ্ছন্দে স্বদেশি কালী বলতে পারি। ‘কালী’ শব্দটি এসেছে ‘কাল’ শব্দের স্ত্রীলিঙ্গ রূপ থেকে। যার অর্থ কৃষ্ণ বা ঘোর কালো বর্ণ। মহাভারতে কালীকে দুর্গার একটি রূপ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। মহাভারতে অবশ্য কালরাত্রি বা কালী নামে আরেক দেবীর উল্লেখ রয়েছে। বর্ণানুসারে যিনি মৃত যোদ্ধা ও পশুদের আত্মাকে বহন করেন। হিন্দু শাক্ত বিশ্বাস অনুযায়ী শাক্ত দেবী কালী বা কালিকা দশমহাবিদ্যার প্রথম মহাবিদ্যা। বিশ্বসৃষ্টির আদি কারণ তিনি। অন্য মতে তিনি আদ্যাশক্তি মহামায়া। বাংলায় শাক্তধর্ম জনপ্রিয় হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই কালীপুজো ব্যাপক আকার নেয়, তৈরি হয় অসংখ্য মন্দির। এইসব মন্দিরে সিদ্ধেশ্বরী, সর্বমঙ্গলা, করুণাময়ী, ভবতারিণী, আনন্দময়ী প্রভৃতি নামের কালী প্রতিমা পুজো হয়। বিভিন্ন তন্ত্র ও পুরাণে দেবী কালীর একাধিক রূপ ভেদের কথা বলা আছে। সেগুলি হলো দক্ষিণকালী, সিদ্ধকালী, গুহ্যকালী, মহাকালী, ভদ্রকালী, চামুণ্ডাকালী, শ্মশানকালী ও শ্রীকালী। বাংলায় দক্ষিণাকালী সবথেকে প্রসিদ্ধ। বাংলায় যত কালীমূর্তি দেখা যায় তার মধ্যে দক্ষিণকালীর সংখ্যা বেশি। একসময় বাংলার ডাকাত ও ভয়ংকররূপ ডাকাতে কালীর প্রচলন ছিল রমরমা। হুগলি জেলার সিঙ্গুরে ডাকাত সনাতন বাগদি ও গগন সর্দার, ত্রিবেণীর বাসুদেবপুরে বুধোডাকাত, জিরাটের কালীগড়ে কালাচাঁদবাবু, বর্ধমান জেলার দক্ষিণডিহির গর্দানমারির বেহারিডাকাত, আরামবাগের চক্রপুরে কাঞ্চন ও পঞ্চু ডাকাত, চিৎপুরের চিতে, রাণাঘাটের রণা—এমন আরও ডাকাতদের রমরমায় জড়িয়ে আছে তাদের আরাধ্য কালীমূর্তি ও পুজো। বাংলার বহু কালীসাধক সংস্কৃতিগত দিক থেকেও শাস্ত চেতনাকে জাগ্রত করেছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য নাম অবশ্যই রামপ্রসাদ সেন। রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের এই সভাকবি তাঁর রচিত গান যা মূলত কালীমাতা ও কন্যাকে সরাসরি নিবেদন। যে গানে ভক্তিরস ছাড়াও দর্শন ও তত্ত্বকতার সন্ধানও অবশ্য মেলে। বাংলার কালীপুজো জনপ্রিয় হওয়ার জন্য রামকৃষ্ণ, বামাখ্যাপা, কমলাকান্তর নাম যেমন স্মরণীয়, মনে হয় রামপ্রসাদের অবদান এঁদের থেকেও বেশি। বলা যায় এঁদের অনাড়ম্বর পুজো পদ্ধতি বাংলার ঘরে ও বাইরে কালীপুজোয় উৎসাহ জুগিয়েছে।

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*