শ্যামাপদ মালাকার:
গ্রামের দিকে বিজয়ার বিকেলই বেশীর ভাগ পরব লাগে। তাই,–
মা’ ঐ রুম হতে হাক দিয়ে আমায় বলল,-“খোকা তুই মণ্ডপে যাবি না?” –আমিও মায়ের প্রশ্নানুসারে উত্তর দিয়ে বসলাম,-আজ-কাল দুগ্গা দেখতে মণ্ডপে যেতে হয় না মা’-পথের ধারে দাঁড়ালে অনেক দুগ্গা দেখতে পাই, –তারমধ্যে পুরানোও দু’একটি পাই,-আমার কথা শেষ হতে না হতেই,-মা’ রেগে বলে উঠল,–“এতো ইয়ারকি এতো বাড় ভাল নয় খোকা! তুই উচ্ছন্নে গেছিস্ তুই একেবারে জাহান্নামে গেছিস্।”
আমি চিরকালই একটু নাস্তিক, তাই ভাবলাম আজের দিনে মা’কে কাঁদিয়ে আর লাভ নেই, তার বিশ্বাস ও মর্য্যাদা রাখার প্রয়াসে বিজয়ার শেষ প্রণামের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লাম,-অশুভনাসিনীর খোঁজে।
সেখানে পৌছে শুনলাম,-উলু আর শঙ্খধ্বনির মহা সমারোহে,-এই মাত্র “মা”কে নিয়ে বেরিয়ে গেল,–সংঘের ছেলেরা।
আর কোলাহল নেই, নেই উড়া ধুলির নিবিড় গন্ধ। অপূর্ণ ভাঙ্গা বিধুর দেহ হতে নিংড়ে নিয়ে গেল ওরা,- মহাবিজয়ার শুভ ক্ষণ।
সদর দ্বারে ভাঙ্গা বাতির ম্লান রশ্মিটা বিসর্জনের শেষ ভাষণের দীর্ঘ পূর্ণচ্ছেদ দিল বলে! নিভে যাওয়া সমস্ত উৎসাহ-উদ্দম অভাগার দখলেই রইল।
তবু মাথা নোয়াতে হবে বিশ্বের দ্বারে, শূন্যবেদীর সমুখে দাঁড়িয়ে অঞ্জলীবদ্ধ করে প্রণাম করতে যেই যাব,–হঠাৎ এক বিভীষিকাময় কণ্ঠে কে যেন ডেকে উঠল,–“খোকা!”। মুহূর্তে চোখ খুলে দেখি, –বিদ্ধস্ত মণ্ডপের পিছে কি একটা নড়ে! আর বিলম্ব না করে,-গিয়ে দেখলাম,-এক বৃদ্ধা।
অপরিচতা সম্পূর্ণ, দৃষ্টি-শক্তির প্রখরতা তেমন আর নেই বললে চলে। নেই উঠে দাঁড়াবার কোনো সামর্থ,–পরনে মলিন ফাটাশাড়ীর গিটে,–পৃথিবীর সমস্ত ইতিহাস যেন ঐখানে পরাজিত।
উপেক্ষা করতে পারলাম না, তাছাড়া ভুবন ভুলানো ডাক,-“খোঁকা।”
জিজ্ঞাসা করলাম,– কিছু বলছো?– সে বলল,–“হ্যাঁ বাবা, সকাল হতে কিছু খায়নি।”
জিজ্ঞাসা করে আরো জানলাম,-সকালের দিকে মায়ের সম্মুখ ভাগেয় ছিল, কিন্তু মন্দিরের পবিত্রতা রক্ষার্থে কমিটির ক’জন ছেলে, মণ্ডপের পিছনে রেখে দিয়ে গেছে।
রাত গভীর হতে লাগল, তাই আর বিলম্ব না করে দশটি টাকার একটি নোট হাতে ধরিয়ে,–তার দীর্ঘপথচলা ধূম্রধুসর ব্যথাভরা কোমল শ্রান্ত দুই চরণে যখন একটি প্রণাম করে উঠে দাঁড়ালাম–দেখি অসূরনাসিনীর চোখে জল।
বাড়ি ফিরতে ফিরতে মনের অজান্তে ভেতর হতে শুধু বেরিয়ে এল,–কে বলে মায়ের বিসর্জন হয়ে গেছে! জগজ্জননী
মণ্ডপের পিছনে রয়ে গেছে।।
Be the first to comment