ভাস্কর ঘোষাল
কৌতুক অভিনয় এক উচ্চমানের শিল্প। এই শিল্পকে তুলে ধরতে বিভিন্ন শিল্পী নানা উপায় অবলম্বন করেছেন। শারীরিক বা মুখের অঙ্গভঙ্গি, অনেকে আবার গলার আওয়াজে রকমফের ঘটিয়ে উপস্থাপন করার চেষ্টা করেছেন। পাশাপাশি সফল কৌতুক অভিনয় করতে গেলে ‘ টাইমিং ‘ বিষয় খুব গুরুত্বপূর্ণ।
এসব কোনও কিছু নিয়ে তাঁকে কোনও দিন ভাবতে হয়নি। তাঁর ছিল সহজ, সরল উপস্থিতি। কি মঞ্চে বা ক্যামেরার সামনে সংলাপ বলার সময়, তেমনই ছিল ‘ টাইমিং ‘ সেন্স। এই সকল গুন ছিল তাঁর জন্মগত। অভিনয় করার সময় তাঁকে ভাবতে হত না। নাটক বা সিনেমায় তাঁর স্বাভাবিক অভিব্যক্তি সহজেই দর্শকের মনে আনন্দের ঢউ তুলতো।
দুই রাজ্যের মধ্যে যুদ্ধের আগে হাঁড়ি হাঁড়ি মিষ্টি নিয়ে দৌড়চ্ছে মানুষ আর তারই মধ্যে একজন আনন্দে দু’হাত তুলে মুক্তির আনন্দ উদযাপন করছে…’ছুটি, ছুটি’! বলে তাঁর এই অভিনয় করার জন্য নির্দিষ্ট পদ্ধতি অবলম্বন করতে হয়নি। সম্পূর্ণতাই ছিল তাঁর স্বাভাবিক প্রকাশ।
সন্তোষ দত্তের আদি নিবাস ঢাকা, কলকাতায় ১৯২৫ সালের ২ ডিসেম্বরে জন্ম। থাকতেন আমহার্স্ট স্ট্রিটের কাছে। দোতলা পৈতৃক বাড়িটি পরিচিত ছিল ‘সুরধ্বনি কুটির’ নামে। তিনি ছিলেন পেশায় আইনজীবী এবং নেশায় অভিনেতা! যাঁর কমেডি অভিনয়ে কোনও দিন কোনও ক্যারিকেচার ছিল না। তাঁকে বলা যায় লাফিং বম্ব । সে বোমার অন্দরে শুধুই ছিল হাস্যরস।
তাঁর মুখে সংলাপ ”রাজকন্যা কি কম পড়িয়াছে?”, বা “Highly Suspicious !”, কিংবা ”এক মিনিট ” আজও সমান ভাবে জনপ্রিয়। এ প্রজন্মের কাছেও তাই তিনি সমান ভাবে গ্রহণীয়।
সত্যজিৎ রায়ের ‘পরশ পাথর’, – এ অভিনয়ের মধ্য দিয়ে সিনেমায় যাত্রা শুরু তাঁর। এরপর ‘তিন কন্যা’, ‘সোনার কেল্লা’, ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’, ‘হীরক রাজার দেশে’– তাঁর সপ্রতিভ অভিনয় আজও তিনি মানুষের মনের মনিকোঠায় রয়েগিয়েছেন।
এইসব সিনেমার বাইরেও অন্য পরিচালকদের সিনেমায় সন্তোষ দত্ত নিজের অভিনয় প্রতিভার সাক্ষর রেখেছেন।
পূর্ণেন্দু পত্রীর ‘মালঞ্চ’, অমল শূরের ‘গোপাল ভাঁড়’, পীযূষ বসুর ‘সিস্টার’, ‘ব্রজবুলি’, তরুণ মজুমদারের ‘গণদেবতা’, দীনেন গুপ্তর ‘মর্জিনা আবদাল্লা’, সলিল দত্তের ‘ওগো বধূ সুন্দরী’, উমানাথ ভট্টাচার্যের ‘চারমূর্তি’, ‘নবীন মাস্টার’, ‘শ্রীমান পৃথ্বীরাজ’, ‘ঘটকালি’, ‘শোরগোল’, ‘হুলস্থুলু’, ‘খেলার পুতুল’ বা ‘সুবর্ণলতা’র মতো অনেক ছবিতে তাঁর অভিনয় আজ উল্লেখযোগ্য।
প্রথম জীবন থেকেই নাটক ছিল তাঁর ভালোবাসা। ব্যাঙ্কের চাকরি প্রায় ১৪ বছর করার পর আইনজীবীর পেশায় আসেন তিনি। পাশাপাশি চলতে থাকে নাটক, অভিনয়ের কাজ। তখনকার ‘রূপকার’ নাট্যগোষ্ঠীর কর্ণধার সবিতাব্রত দত্তের পরিচালনায় ‘চলচ্চিত্রচঞ্চরী’তে ‘ভবদুলাল’ রূপে আবির্ভূত হন সন্তোষ দত্ত। আর সেই নাটক দেখেই তাঁকে পছন্দ করেন সত্যজিৎ রায়।
সন্তোষ দত্ত মানেই জটায়ু থেকে অবলাকান্ত। ”শুধু তুমি নয় অবলাকান্ত, অনেকেরই বলার সময় খেয়াল থাকে না।” ভাষাবিদ গগন সেন রূপে উত্তম কুমার ও সন্তোষ দত্তর অমর বন্ধুত্বের জুটি। এই গানেই সুমিত্রা মুখার্জীকে দেখে সিনেমার চরিত্র অবলাকান্তের ”ম্যা ম্যা ম্যাডাম!” — বলা আজও সমান জনপ্রিয়। কিংবা সাবিত্রী ও মৌসুমী চট্টোপাধ্যায়কে ” বলতে নেই গুরুজন ” সংলাপ চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে চিরকাল।
তবে শিল্পীর অকপট স্বীকারোক্তি, নাটক তাঁর সিনেমার চেয়েও বেশি প্রিয় ছিল। তাই সবিতাব্রত দত্ত, নির্মল কুমারদের নিয়ে নাট্যসংস্থা করেন ‘আনন্দম’। পরে এই নাট্যদলের নাম হয় ‘রূপকার’।
রূপকার’-এ তাঁর অভিনয় দেখেই সত্যজিৎ রায় তাকে ‘পরশ পাথর’ ছবির জন্য সিলেক্ট করেন। সেখান থেকেই ইতিহাস তৈরি করে জটায়ু চরিত্র, যার কোনও বিকল্প হয়না। যেকারণে সন্তোষ দত্তের মৃত্যুর পর সত্যজিৎ রায় বলেছিলেন ফেলুদা আর করা সম্ভব হবে না। কারণ জটায়ু নেই । আসলে এক একটা চরিত্র এক এক অভিনেতার সিগনেচার মার্ক।
আজও লালমোহন বাবু বা অবলাকান্তদের সারল্য খুঁজে পেতেই তাঁরই আদলে তৈরি হয় ওয়েব সিরিজের চরিত্র। খুবই কঠিন কাজ। সন্তোষ দত্তর ঐ সারল্যর যে নকলনবিশ হয় না। ওই স্বতন্ত্র সারল্যই জটায়ুকে অমর করে রেখেছে। তবে লালমোহন বাবুতেই তিনি আটকে থাকেননি। যখন যে চরিত্র করেছেন সেই সেই চরিত্রে নিজেকে ডুবিয়ে দিয়েছেন। আসলে সব চরিত্রেই তিনি ছিলেন সমান স্বাবলম্বী।
তাই সত্যিটা হল, কিছু মানুষকে কোনও দিন ‘ছুটি’ দেওয়া যায় না মন থেকে। যেমন জটায়ু।
‘
Be the first to comment