চা দোকানের বুদ্ধিজীবি

flcikr
Spread the love

বিপ্লব সৎপতিঃ

ফুটবল টুর্নামেন্টে সেমিফাইনেলে হারার পর আমাদের দলটা ছত্রভঙ্গ হয়ে যে যার নিজের মতো করে বাড়ি চলে গেল। আমরা জনকয়েক, মানে যারা এখনো বাড়ি যাই নি, সেনাদের বিজয় মিছিলের মতো ফুটবলের সাজসরঞ্জাম নিয়ে রাস্তার মাঝ বরাবর হাটছি। আমাদের টিমের আমি একনম্বর ‘ওয়েটিং ‘ প্লেয়ার। কেউ আহত হয়ে মাঠ ছাড়লে ১৩নাম্বারের প্লেয়ার মাঠে নেমে যায়। ভুলেও একনম্বর ওয়েটিং লিস্টে নাম উঠাবার প্রতিযোগীতা করে না। প্লেলারদের জল,কাগজ পৌছানো থেকে শুরু করে প্লেয়ারদের খাতায় নাম লেখানো প্র্যন্ত আমি একহাতে সামলাই । যাইহোক, সামনের ‘ঠেলাগাড়িতে’ একটি ছেলেকে ঘিরে জনচারেক মেয়ে পিঠে পিঠ ঠেকিয়ে দাড়িয়ে আছে। দেখেই বোঝা যায় নতুন জামাইয়ের ঘাড় ভেঙে চপ,ঘুঘনি খাওয়ার জন্য এরা প্রস্তুত। শুধু গ্রীন সিগনালের অপেক্ষা। প্রত্যেকেই আমাদের পরিচিত কিন্তু মেয়েগুলি আমাদের দেখে মুখে রুমাল চেপে এমন ভাব করল যেন আমরা সরাসরি ‘মঙ্গল’ গ্রহ থেকে ল্যান্ডিং করেছি। ওদের পাত্তা না দিয়ে সামনের চা দোকানের বাইরে একটি ‘বাঁশের মাচা’ দখল করলাম। ওদিককার ‘মাচাতে’ প্রকাশদা ও বেশকয়েক জন কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলোচনা করছে মনে হল। আলোচনা ঠিক বলা যায় না প্রকাশদা উত্তেজিত ভঙ্গীতে হাত নেড়ে কিছু বলছেন আর বাকিরা সবাই মাথা দুলিয়ে তাতে সায় দিচ্ছেন। প্রকাশদা প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষক। বছর সাতেক আগে তিনি স্কুলে চাকরি পেয়েছেন। ইদানিং রাস্তার ধারে দুতালা বাড়ি তুলেছেন।। আমি ভাবলাম, আয়রন মুক্ত জলের প্রোজেক্টের কাজটা শুরু করার জন্য বিডিও অফিস যাওয়ার ব্যাপারে আলোচনা চলছে।শোনার জন্য ওদের দিকে এগিয়ে গেলাম। প্রকাশদার আলোচনা শুনে অবাক হয়ে গেলাম। এদিকে ‘চীন’ ও ‘ভারত’ ‘ডোকালাম ইস্যু’ এখন অতীত বলে ভুলতে চাইছে। আর এই গান্ডু ‘মাচার’ উপর বসে আসন্ন ভারত, চীন যুদ্ধে আমেরিকা,রাশিয়া, জাপান কে কার পাশে দাড়াবে,তার বড়ো বড়ো লেকচার দিচ্ছেন। যারা মাথা নেড়ে প্রকাশদাকে সর্মস্থন করছিল, তাদের মুখের দিকে তাকাতেই চিনতে পারলাম। এরা সবাই প্রকাশদার জমিতে কাজ করে। বেচারিরা বোধহয় একটা দেশ, নিজের জায়গা থেকে উঠে কীভাবে পাশে দাড়াবে, ব্যাপারটা অনুমান করার চেষ্টা করছিল। কারন তারা মানুষকে কাঁধ ঠেকিয়ে পাশে দাড়াতে দেখেছে কিন্তু পুরোদেশ!! আমাকে দেখতে পেয়ে প্রকাশদা বললেন,”মাগারাম আসছে না কেন? দিনচার শালার কোনো পাত্তাই নেই। তুইতো বলেছিলি রোজ আসবেক?” তারপর নির্বাক শ্রোতাদের উদ্দেশ্যে বললেন, “এই শালা বাউরির বাচ্চাদের বিশ্বাস করতে নেই। ছোটোলোকের বাচ্চাতো স্বভাব যাবেক কোথায়? “আমি আমতা আমতা করে বললাম, “আমার সাথে দেখা হলে বলব”
“বলবি তো, নয়তো একটা টাকাও পাবে না।”
মাগারাম কাঠের কাজ করে। প্রকাশদার সাথে আমি যোগাযোগ করে দিয়েছিলাম। মাগারামের ‘ছয়’ ছেলেমেয়ে। ‘ছোটোপরিবার পরিকল্পনা’ বিডিও অফিসের দেওয়ালের বাইরে আসতে পারেনি। জমি এককাঠাও নেই। কিছু জমি লিজ নিয়ে কুমড়ো চাষ করে। ছেলেমেয়ের রোগ অসুখ নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। আমি নিশ্চিত জানি ‘ও’ কুমড়ো ভাঙছে তাই প্রকাশদার কাজে আসতে পারছে না। এদিকে প্রকাশদা, জল পড়লে স্কুল অফ। মুড খারাপ থাকলে স্কুল অফ। বাড়ির সমস্ত কাজ সেরে ঘন্টা দুই পরে স্কুলে পদধুলী দেবেন। প্রধান শিক্ষক কিছু বললে, পুরো স্কুল ‘ওনার’ বিরুদ্ধে চক্রান্ত চালাচ্ছে বলে চেঁচাবেন। তারপর ‘ডিএ টিএ’ নিয়ে চা দোকানে এমন ঝড় তুলেন, ছোটোখাটো ‘আয়লা’ না হয়ে যায়। যদিও এটা নিশ্চিত, মাইনের একটা টাকাও কাটা যাবে না। আর মাগারাম কাজ না করলে বেতন পাবে না। আর এই প্রকাশদা বিচার করছেন, কে ছোটোলোক? কে ভদ্রলোক? আমার এক বন্ধু এদের কে ‘বুদ্ধিবীচি’ বলে।

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*