তপন মল্লিক চৌধুরী
চ্যাপলিন যুক্তি তর্কের উর্ধ্বে চলচ্চিত্রে এককভাবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শিল্পী, নিশ্চিতভাবে সবচেয়ে অসাধারণ অভিনেতা এবং সম্ভবত এখনো চলচ্চিত্রের সবচেয়ে সার্বজনীন মূর্তি। ব্রিটিশ ফিল্ম ইনস্টিটিউট চ্যাপলিনকে বিশ্ব সংস্কৃতির অত্যুচ্চ ব্যক্তিত্ব বলে বর্ণনা করেছে। কোটি মানুষের মুখে হাসি আনার জন্য এবং একটি শিল্পকে শিল্পকলায় রূপ দেওয়ার জন্য ঊনবিংশ শতাব্দীর ১০ জন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছে টাইম সাময়িকী। আসলে দ্য ট্রাম্প প্রতিমূর্তিটি সাংস্কৃতিক ইতিহাসের একটি অংশ হয়ে ওঠে। সিমন লোভিশের মতে, যারা চ্যাপলিনের একটি চলচ্চিত্রও কখনো দেখেনি, তাদের কাছে, এবং যেখানে কখনো চলচ্চিত্র প্রদর্শিত হয়নি, সেই জায়গাতে এই চরিত্রটি সহজে চেনা যায়। আর কোনো কৌতুকাভিনেতা তাঁর মতো কি বিশ্বজোড়া প্রভাব রাখতে পেরেছে ? দ্য ট্রাম্প চরিত্র সম্বলিত চ্যাপলিনের চলচ্চিত্রগুলি চলচ্চিত্র ইতিহাসের সবচেয়ে বাকপটু ও হাস্যরসে অভিব্যক্ত। এই চরিত্রের সঙ্গে যুক্ত স্মরণিকাগুলি এখনো চড়া মূল্যে নিলামে বিক্রি হয়। ২০০৬ সালে দ্য ট্রাম্পের পোশাকের একটি বাউলার হ্যাট ও একটি বাঁশের বেত লস অ্যাঞ্জেলেসে এক নিলামে ১৪০,০০০ মার্কিন ডলারে বিক্রি হয়।
চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে চ্যাপলিনকে চলচ্চিত্রের অগ্রদূত এবং বিংশ শতাব্দীর শুরুর সময়ের সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব বলে মনে করা হয়। তাঁকে প্রায়ই এই মাধ্যমের প্রথম শিল্পী বলে অভিহিত করা হয়। চলচ্চিত্র ইতিহাসবিদ মার্ক কোজিন্স লিখেছেন, চ্যাপলিন শুধু চলচ্চিত্রের ভাবমূর্তিই পরিবর্তন করেননি, তিনি সামাজিকতা ও ব্যাকরণও পরিবর্তন করেছেন এবং তিনি দাবী করেন ডি ডব্লিউ গ্রিফিথ যেমন চলচ্চিত্রে নাট্য ধারা বিকাশে অবদান রেখেছেন, চ্যাপলিনও তেমনি হাস্যরসাত্মক ধারা বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। তিনিই প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য হাস্যরসাত্মক চলচ্চিত্রকে জনপ্রিয় করে তোলেন এবং করুণ রস ও চাতুর্যময়তা যোগ করেন। যদিও তাঁর কাজগুলো বেশিরভাগই স্ল্যাপস্টিক শ্রেণিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়, আর্ন্স্ট লুবিট্চ পরিচালিত দ্য ম্যারিজ সার্কেল (১৯২৪) ছবিটিতে চ্যাপলিনের আ ওম্যান অব প্যারিস (১৯২৩) এর প্রভাব ছিল এবং এর মাধ্যমেই উন্নত ধরনের হাস্যরসের বিকাশ ঘটে। ডেভিড রবিনসনের মতে, চ্যাপলিনের উদ্ভাবন অচিরেই চলচ্চিত্র শিল্পের নিয়মিত চর্চার অংশ হিসেবে গৃহীত হয়। চ্যাপলিন পরবর্তী অনেক চলচ্চিত্র নির্মাতা মনে করেন তাদের চলচ্চিত্র নির্মাণে চ্যাপলিনের প্রভাব রয়েছে। ফেদেরিকো ফেল্লিনি মনে করেন, ‘চ্যাপলিন অনেকটা আদমের মতো, আমরা সবাই যার উত্তরসূরি’। জাক তাতি বলেন, ‘তিনি না থাকলে হয়ত আমি কখনো চলচ্চিত্র নির্মাণ করতাম না’, এবং তার মঁসিয়ে হুলো চরিত্রটি দ্য ট্রাম্পের আদলে তৈরি। রনে ক্ল্যের বলেন, ‘তিনি সব চলচ্চিত্র নির্মাতাকে অনুপ্রাণিত করেছেন’। মাইকেল পাওয়েল, বিলি ওয়াইল্ডার, ভিত্তোরিও দে সিকা এবং রিচার্ড অ্যাটেনব্রোও চ্যাপলিনের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছেন। রুশ চলচ্চিত্র নির্মাতা আন্দ্রেই তার্কভ্স্কি চ্যাপলিনের প্রশংসা করে বলেন, ‘চলচ্চিত্র ইতিহাসে তিনি একমাত্র ব্যক্তি যিনি নিঃসন্দেহে কোন ছায়া ব্যতীত কাজ করে গেছেন। তাঁর রেখে যাওয়া চলচ্চিত্রগুলো কখনো পুরনো হবে না’।
চ্যাপলিন তাঁর পরবর্তী সময়ের কৌতুকাভিনেতাদের প্রভাবিত করেছেন। মার্সেল মার্সো বলেন তিনি চ্যাপলিনকে দেখেই মুকাভিনেতা হতে অনুপ্রাণিত হন। রাজ কাপুর পর্দার জন্য চ্যাপলিনের দ্য ট্রাম্প সত্তা গ্রহণ করেন। মার্ক কোসিন্স চ্যাপলিনের কৌতুকের ধরনের সাথে ফরাসি মঁসিয়ে হুলো ও ইতালীয় তোতোর চরিত্রের মিল খুঁজে পান। অন্যান্য ক্ষেত্রে চ্যাপলিনের অভিনয় থেকে অনুপ্রাণিত চরিত্র হল, কার্টুন চরিত্র ফেলিক্স দ্য ক্যাট ও মিকি মাউস। এছাড়া তিনি দাদা শিল্প আন্দোলনের অনুপ্রেরণা। ইউনাইটেড আর্টিস্ট্সের একজন অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হিসেবে তিনি চলচ্চিত্র শিল্প বিকাশে ভূমিকা রেখেছেন। জেরাল্ড মাস্ট লেখেন, যদিও ইউনাইটেড আর্টিস্ট্স কখনোই মেট্রো-গোল্ডউইন-মেয়ার বা প্যারামাউন্ট পিকচার্সের মতো বড় কোম্পানি হতে পারে নি, তবু পরিচালকরা তাদের চলচ্চিত্র প্রযোজনা করবেন এটি একটি কালোত্তীর্ণ চিন্তাধারা ছিল।
একবিংশ শতাব্দীতেও চ্যাপলিনের কয়েকটি চলচ্চিত্র সর্বকালের সেরা চলচ্চিত্র ও ধ্রুপদী চলচ্চিত্রের আখ্যা লাভ করে। ২০১২ সালে সাইট অ্যান্ড সাউন্ড সাময়িকীর ভোটে, যেখানে চলচ্চিত্র সমালোচক ও নির্মাতারা তাদের পছন্দের সেরা দশ চলচ্চিত্রের জন্য ভোট দিয়ে থাকেন, সেখানে সিটি লাইট্স সমালোচকদের ভোটে সেরা ৫০, মডার্ন টাইমস সেরা ১০০ এবং দ্য গ্রেট ডিক্টেটর ও দ্য গোল্ড রাশ সেরা ২৫০ এ স্থান করে নেয়। পরিচালকদের ভোটে নির্বাচিত সেরা ১০০ চলচ্চিত্রের তালিকায় মডার্ন টাইমস ২২তম, সিটি লাইট্স ৩০তম এবং দ্য গোল্ড রাশ ৯১তম স্থান অধিকার করে। ২০০৭ সালে আমেরিকান ফিল্ম ইনস্টিটিউটের করা সর্বকালের সেরা মার্কিন চলচ্চিত্র তালিকায় সিটি লাইট্স চলচ্চিত্রটি ১১তম স্থান লাভ করে এবং দ্য গোল্ড রাশ ও মডার্ন টাইমস সেরা ১০০ তালিকায় স্থান লাভ করে। চ্যাপলিনকে নিয়ে নিয়মিত বই প্রকাশ হয় এবং গণমাধ্যম বিষয়ক পণ্ডিত ও চলচ্চিত্র সংরক্ষণবিদদের জন্য চ্যাপলিন একটি জনপ্রিয় ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
Be the first to comment