চলচ্ছক্তি

Spread the love

সহেলী রায়
(১)
‘অমৃতালয়’ এ পৌঁছে সিদ্ধার্থ চুপচাপ খানিকক্ষণ বসলেন। নীরবে থাকা তাঁর স্বভাববিরূদ্ধ। আজ পর্যন্ত কোনদিন এতটা চুপ করে থাকেননি তিনি। এমনকি মিতালি যেদিন বত্রিশ বছরের হৃদয়ের সাথে একাত্মভাবে জড়িয়ে যাওয়া সিদ্ধার্থ, সংসার, ছেলে ছেড়ে চোখ বুজেছিল সেদিনও সিদ্ধার্থ ভেতরের যন্ত্রণাকে তাঁদের একমাত্র ছেলে জিষ্ণুর কাছে লুকিয়ে রেখে ওর চোখে মিতালি হয়ে উঠেছেন বারবার। বন্ধ ঘরে চোখ ভিজলেও , লোকসমক্ষে হৈ-হুল্লোড় করে মিতালির অভাব মিটিয়েছেন তিনি। মিতালি অবশ্য সিদ্ধার্থের এই সবসময় চেঁচামেচি, হৈ-হুল্লোড়ে মাঝেমধ্যেই বিরক্তি প্রকাশ করতেন। আবার দু-তিন মিনিট মানুষটা চুপ থাকলেই জিগেস করতেন, ‘ কি গো শরীর টরীর খারাপ নাকি? অমন মিইয়ে আছ?’ একবার পুজোর সময় একজোড়া ইলিশ প্রায় দু কেজি ওজনের এনে কি হম্বিতম্বি। মিতালি তো ভেবেই অস্থির , জিষ্ণু বিদেশে, এত ইলিশ দুজনে খাবে কি করে। পাড়ার পুজো কমিটির ছেলেদের তিনি আগেই নেমন্তন্ন দিয়ে এসেছেন। ছেলেগুলো নাকি খুব খাটছে। তাদের উৎসাহ দিতেই রাতে ফিস্টির ব্যবস্থা।
পাড়ার ক্লাব সিদ্ধার্থকে প্রেসিডেন্ট বানাতে চেয়েছিল বহুবার। তিনি এসব উপাধি এড়িয়েই গেছেন। তিনি শুধুমাত্র পাড়ার প্রাণ হতে চেয়েছেন। আর তিনি তাইই ছিলেন। শেষমেশ তাঁর ডিসিশনেই পাড়ার সব উৎসবানুষ্ঠান নির্বিঘ্নে সমাপ্ত হত। সুকান্তপল্লী সিধুবাবুর পাড়া নামেই বেশি পরিচিত ছিল। আট থেকে আশি সকলের প্রিয় ছিলেন সিদ্ধার্থ। সেই সুকান্তপল্লীরই বহুসাধের দোতলা বাড়িখানা একদিন ছাড়তে হল সিদ্ধার্থকে। মিতালির মৃত্যুর বছর দেড়েক আগে জিষ্ণু উড়ে আসে মিসিসিপি থেকে । কলকাতায় মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানীর ভাইস প্রেসিডেন্ট পদে জয়েন, তার সাথে ডিম্পিকে বিয়ে দুটোই সাড়ল তড়িঘড়ি। সিদ্ধার্থ ডিম্পির শ্বশুর কম, বন্ধু বেশি হয়ে উঠেছিলেন। মিতালির মৃত্যুর পর আরও বেশি জড়িয়েছেন। চাকুরিরতা বৌমাও পুত্রবধূ কম, বরং শাসন ও আবদার করার এক মানুষ পায়। যদিও প্রাইভেট কোম্পানির চাকরির চাপে সে সংসারে কোন সময়ই দিত না। আর উইকেন্ড মানেই জিষ্ণুর সাথে ছোটখাট ট্যুর বা লেটনাইট পার্টি। এসব ব্যাপারে অবশ্য সিদ্ধার্থের উৎসাহ অপরিসীম। জীবনটাকে আনন্দ দিয়ে নিংড়ে নিতে হয় এটাই তাঁর একমাত্র থিওরি। কথাটা ডিম্পিই বলেছিল তাঁকে, ‘ বাপি, বাড়িটা বিক্রি করে একটা ট্রিপল বেডরুমওয়ালা ফ্ল্যাট নি?’
‘কেন রে মা, এখানে অসুবিধে হচ্ছে?’ সিদ্ধার্থ অবাক হয়েছিলেন
‘ হ্যাঁ বাপি, আমাদের অফিসের পার্টি এখানে আরেঞ্জ করার অসুবিধে, ঘর ছোট , কেউ নর্থ এ আসতেই চায় না। যা লোন লাগবে তাতে আমরা দুজনে সবটা পারব না ,তাই ভাবছিলাম এটা বিক্রি করলে অনেকটাই ইজি হয়।’ কোন রাখাঢাক না করেই ডিম্পি বলল কথাগুলো
‘ বেশতো, জিষ্ণুর কি ইচ্ছা? তার কথাও তো জানা উচিৎ’
‘ ও তোমাকে বলতেই পারছে না, তুমি তো ওকে জানই বাপি’
দরাজ গলায় প্রচন্ড হেসে বুকের হাল্কা চিনচিনে ব্যথাটা লুকোলেন সিদ্ধার্থ। এত বছরের পুরনো পাড়া, মিতালির এত স্মৃতি। কিন্তু ছেলেমেয়ের ইচ্ছের চেয়ে বড় কিছুই নেই। মত দিলেন। যেদিন সিদ্ধার্থরা সাউথসিটিতে উঠে গেলেন সুকান্তপল্লীতে শোকের ছায়া নামল। সেদিনও সিদ্ধার্থ সবাইকে মাতিয়ে রাখলেন।‘ আরে আমি মারা যাচ্ছি নাকি? সুকান্তপল্লীর শিকড়ে শিকড়ে আমি আছি, আমায় সরানো এতই সহজ?’
সাউথসিটিতেও তিনি দমলেন না। তাঁর বয়সীদের নিয়ে বানিয়ে ফেললেন ‘ইচ্ছেডানা’। শুধু তাই নয় প্রতি তিনচারমাস অন্তর দেশভ্রমণ, নানারকম আক্টিভিটি, খাওয়াদাওয়া , জীবনের এক ইঞ্চি সময়ও তিনি নষ্ট করতে নারাজ। জিষ্ণু, ডিম্পিও নিজেদের মত করেই চলছিল। কেউ কারোর সংঘাতে আসার কোন সুযোগই নেই। উল্টে সংসারের বেশিরভাগ দায়িত্ব সিদ্ধার্থ একা হাতেই সামলাচ্ছিলেন। বাজার, রান্নার লোক, ঠিকে লোক যাবতীয় তাঁরই মাথাব্যথা যাতে ডিম্পির কোন অসুবিধে না হয়।
(২)
ইচ্ছেডানার প্রথম দুর্গাপুজো। সিদ্ধার্থ পুরনো পাড়ার অভিজ্ঞতার ভরসায় অবশেষে সবাইকে নিয়ে ঝাঁপালেন। চারদিন ধরে এফ-ব্লকের সমস্ত বাসিন্দাদের খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা, ফাংশান কিছুই বাদ রাখলেন না। সবাই নতুন জীবন পেল। অষ্টমীর রাতে সব সেরে ফিরতে বেশ দেরিই হল সিদ্ধার্থর। জিষ্ণুরা তখনও ফেরেনি। এমনিতে দেরি হলে সিদ্ধার্থকে ফোন বা টেক্সট করে জানায় ডিম্পি। পুজোর সময় ছেলেমেয়েগুলো বেশিই মেতেছে এই ভেবে মন শান্ত রাখলেন সিদ্ধার্থ। ভোররাতে ফিরল ওরা। সিদ্ধার্থ সারারাত জাগা। বহুবার ওদের ফোন করেও সাড়া পাননি।
‘এমন তো করিস না, একবার জানাবি তো’ খুব উদ্বিগ্ন মুখে বললেন সিদ্ধার্থ
‘বাপি তোমার সাথে কথা আছে’ ডিম্পি উত্তর দিল
‘কিছু হয়েছে?’ সিদ্ধার্থ আরও উদ্বিগ্ন
জিষ্ণু নিজের ঘরে চলে গেল।
‘বাপি, আমার বাবা মা বারাসাতের বাড়িতে সমস্যায় আছেন। তুমি তো জানই বাড়িটা কাকু বানিয়েছিল, কাকু ওদের উঠে যেতে বলছে বা অর্ধেক টাকা। সবটাই অসম্ভব। বাবার অবস্থা তো জানই। আমি বা জিষ্ণু এখন এতগুলো টাকা কোথায় পাব? ফ্ল্যাটের লোন। তাই ঠিক করলাম বাবামাকে এখানে এনে রাখব’।
‘এতো অতি উত্তম প্রস্তাব রে, দারুণ হবে’ সিদ্ধার্থ চনমনে হয়ে উঠলেন।
‘ না বাপি এখানেও প্রব্লেম, মা কিছুতেই মেয়ের বাড়িতে থাকবেন না। আজ কল্যাণীর কাছে একটা ওল্ডেজ হোম দেখে এলাম। ‘অমৃতালয়’। বাপি তোমার ভালই লাগবে। আর মাবাবাও এখানে কম্ফর্ট ফিল করবেন। ওদের নিজের বাড়িই মনে হবে, দশমীর দিন বিকেলে তোমায় পৌঁছে দেব’
অমৃতালয়ে পৌঁছে চুপচাপ বসে রইলেন সিদ্ধার্থ। আরও একটা দিন কি পাওয়া যেত না? ইচ্ছেডানার একটা বিজয়া সম্মিলনীর কথা হয়েছিল। আসবার সময় কারও সাথে দেখাই হল না। বিসর্জনের ঢাকের আওয়াজে এতদিন মন পাড়ার ছেলেদের সাথে নাচত আজ সেই শব্দই বড্ড মনখারাপ করাচ্ছে। ঘর থেকে বেরিয়ে চারপাশটা হাঁটলেন। এত বড় উৎসব পেরিয়ে গেল। অথচ বিন্দুমাত্র রেশ এখানে নেই। দু-একজন বৃদ্ধ-বৃদ্ধা এমনভাবে চলাফেরা করছেন যেন তাঁরা জীবন নয় মৃত্যু অতিবাহিত করছেন। সিদ্ধার্থও একই রকম হারের অনুভূতি টের পেলেন। কিছুতেই মেনে নিতে পারলেন না।
অমৃতালয়ের কেয়ারটেকার সুদেব ভোরবেলা মর্নিংওয়াকে বেরিয়ে দেখলেন বাগানের পাশে সব সদস্যরা জমায়েত হয়ে, কালকের নতুন সদস্য সিদ্ধার্থবাবুর বক্তব্য শুনছেন। মাঝেমধ্যে খুব জোরে হাসির শোরগোলও উঠছে যা এখানে বিরল। নতুন ইচ্ছেডানা মেলার মিটিং চলছে।

সমাপ্ত

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*