ডি-ভোটারের আতঙ্ক কার্যত ভাইরাল ফিভারের আকার নিলো অসমের বাঙালিদের মধ্যে; পড়ুন বিস্তারিত!

Spread the love
একা রামে রক্ষে নেই সুগ্রীব দোসর!
জাতীয় নাগরিক পঞ্জিকরণ (এনআরসি) তো ছিলই। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ডি-ভোটারের (ডাউটফুল ভোটার) আতঙ্ক। সেই আতঙ্কই কার্যত ভাইরাল ফিভারের আকার নিয়েছে অসমের বাঙালিদের মধ্যে।
গত জুলাই মাস থেকে তিন জন বাঙালি আত্মহত্যা করেছেন অসমে। ভিটে হারানো, নাগরিকত্ব হারানোর আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন অসমের বাঙালিরা। মফস্বল এবং গ্রামের গরিব, নিম্ন মধ্যবিত্ত বাঙালিদের মধ্যে এই আতঙ্ক সবচেয়ে বেশি।
গত জুলাই মাসে অসমের ওদালগুড়িতে আত্মহত্যা করেছিলেন গোপাল দাস। তাঁর স্ত্রীর নামে এসেছিল ডি-ভোটারের নোটিস। ২১ অক্টোবর ভিটে হারানোর আতঙ্কে আত্মহত্যা করেছেন দরং জেলার খারুপেটিয়ার আইনজীবী তথা অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক নিরোদবরণ দাস। দু’দিন আগে ডি-ভোটারের তালিকায় নাম চলে যাওয়ায় বাড়ির সামনের একটি গাছে গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলে পড়েন সাইকেল মেকানিক দীপক দেবনাথ।
ডি-ভোটার কী?
অসম পুলিশের বর্ডার ব্রাঞ্চ রয়েছে। যাদের কাজ খবরাখবর নিয়ে সন্দেহজনক ভোটারদের চিহ্নিত করা। অনেকের মতে,  অধিকাংশ ক্ষেত্রে কোনও নথি না দেখেই কাউকে ডি-ভোটারের তালিকায় ফেলে দেয় বর্ডার ব্রাঞ্চ। ডি-ভোটারের তালিকায় নাম ওঠা মানেই অসমের ফরেনার্স ট্রাইবুনাল সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে নোটিস পাঠায়। ওয়াকিবহাল মহলের মতে,  কোর্ট-কাছারির আতঙ্কেই জেরবার হয়ে যান গরিব-মধ্যবিত্ত মানুষ। উকিলের খরচ ও ঘুষের বহর বইতে পারার সাধ্য থাকে না তাঁদের। ঠিক এই কারণেই সাইকেল মেকানিক দীপক গাছে ঝুলে পড়েছেন বলে দাবি করেছে তাঁর পরিবার।
প্রসঙ্গত, এনআরসি আর ডি-ভোটারের তালিকা নিয়েও বিস্তর গোলমাল রয়েছে বলে খবর।
কী গোলমাল?
এমন অনেক ব্যক্তি আছেন যাঁদের নাম রয়েছে এনআরসি তালিকায়। কিন্তু তাঁদের আবার বর্ডার ব্রাঞ্চ দেগে দিয়েছে ডাউটফুল ভোটার হিসেবে। আবার আদালতের নির্দেশ আছে, ডি ভোটার ও তাঁর পরিবারের নাম এনআরসিতে উঠবে না। প্রয়োজনীয় নথি নিয়েও প্রশাসনিক সিদ্ধান্তে বারবার বদল আসছে।
১৯৭১ বা তার পরে আসা মানুষ, এ দেশের বৈধ নাগরিক? নাকি নন? মূল আলোচ্য বিষয় ছিল এটাই। কিন্তু সেই বিষয়টি এখন অসমে রূপ নিয়েছে বাঙালি বনাম অহমিয়ায়। এর মধ্যে নাগরিকত্বের প্রমাণ হিসেবে যে ১৫ নথিকে আগে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছিল, তার মধ্যে পাঁচটি নথিকে এনআরসি কো-অর্ডিনেটর প্রতীক হাজেলা গ্রহণযোগ্য নয় বলে সুপ্রিম কোর্টে হলফনামা জমা দিয়েছেন। ১৯৫১ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত কোনও নাগরিকের পরিবার যে ভারতে ছিল, তার প্রমাণ হিসেবে সেই  সময়কার ভোটার তালিকা আগে গ্রহণ করা হচ্ছিল। কিন্তু দেখা যাচ্ছে  রাজ্য সরকারের হাতেই পূর্ণাঙ্গ ভোটার তালিকা বা ১৯৫১ সালের পূর্ণাঙ্গ এনআরসি নেই। আর ভোটার তালিকা পাওয়া এবং তা মেলানো এতগুলো দশক পর খুব একটা সহজ কাজ নয়। তার উপর আবার এই সময়ের মধ্যে অসমে জেলা বেড়েছে। এবং এই নথি নিয়ে গোটা রাজ্য জুড়ে এতটাই জালিয়াতি চলেছে যে প্রশাসন ঘোষণা করেও তা বাতিল করতে বাধ্য হয়। এখন ডি-ভোটারদের বাড়িতে ট্রাইব্যুনালকে নোটিস পাঠানোও বন্ধ রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে প্রশাসনের তরফে।
এরমধ্যে দেশের অ্যাটর্নি জেনারেল, রাজ্যের তরফে কেন্দ্রের সলিসিটর জেনারেল, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র সচিব এবং কেন্দ্র ও রাজ্যের কর্তাদের কাছে গোটা বিষয়টি নিয়ে পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশন জমা দিয়েছেন হাজেলা। সুপ্রিম কোর্ট কেন্দ্র ও রাজ্যকে ৩০ অক্টোবরের মধ্যে পাঁচটি নথি বাদ দেওয়ার বিষয়ে মতামত জানাতে বলেছে। কিন্তু রাজ্যের মত, এনআরসিতে নাম ঢোকানোর ক্ষেত্রে ব্যাপক কারচুপি হয়ে থাকলে সংবেদনশীল সব এলাকার খসড়া তালিকা ফের যাচাই করা দরকার। যদি পুনরায় এনআরসি তালিকা খতিয়ে দেখার নির্দেশ দেয় সুপ্রিম কোর্ট তাহলে ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে সম্পূর্ণ তালিকা প্রকাশ সম্ভব নয় বলেই মত অনেকের।
কিন্তু বাঙালিদের মধ্যে এই আতঙ্ক কেন?
অনেকের মতে, অসমের সংবাদমাধ্যমের একাংশ ধারাবাহিকভাবে বাঙালি বিদ্বেষ জারি রেখেছে। এবং বিভিন্ন টক শোতেও প্রচ্ছন্ন ভাবে বিরোধ উস্কে দেওয়া হচ্ছে। এই আগুনে আবার ঘি ঢেলেছে আলফার উগ্র বক্তব্য।
রাজনৈতিক পরিবেশও থমথমে অসমে। পর্যবেক্ষকদের মতে,  কংগ্রেস না পারছে গিলতে না পারছে ওগরাতে। কারণ এনআরসি কংগ্রেসের সময়েরই সিদ্ধান্ত। বিজেপি শুধু কার্যকর করছে। কিন্তু কংগ্রেসও গোটা প্রক্রিয়া নিয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছে। তরুণ গগৈদের দল দাবি করেছে, বিজেপি সরকার যা করছে, যে ভাবে করছে তাতে সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকেই উস্কে দেওয়া হচ্ছে। দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার যে বড় চিন্তা থেকে এনআরসি করার কথা কংগ্রেস ভেবেছিল– তা একেবারেই হচ্ছে না। এরমধ্যে আবার বিজেপি-র জোটসঙ্গী অসম গণ পরিষদ দূরত্ব বাড়িয়েছে সরকারের সঙ্গে। কারণ অসম চুক্তির মূল কথাই ছিল ১৯৭১ সালের পরবর্তীতে যারা এসেছে, তাদের ফেরাতে হবে। এ দিকে নাগরিক সংশোধনী বিল আবার বলছে, ২০১৪ পর্যন্ত যারা এ দেশে এসেছে, তাদের নাগরিকত্বের বৈধতা দেওয়া হবে।
অসমের এনআরসি আপাতত আইনের জটে আটকে। কিন্তু ‘বাঙালি খেদাও’ আতঙ্কে গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলে পড়ছেন একের পর এক। স্কুল মাস্টার থেকে সাইকেল মেকানিক।

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*