রাজকুমার ঘোষঃ
অজয় কখনো ভাবেনি তার জীবন তাকে একটা বড় প্রশ্নের সামনে দাঁড় করিয়ে দেবে ! সে কখনো ভেবেছিলো সেই ১৫ বছর আগে তার না চাওয়া ভুলের জন্য নিজের কাছে জবাবদিহি করতে হবে ! ……… নিউ আলিপুরের মোড়ে স্বপ্নার সাথে আজ হঠাৎ দেখা হয়ে গেল অজয়ের, দেখা হওয়া মাত্রই অজয় স্বপ্নাকে চা এর আমন্ত্রণ জানালো । এক নিরালা রেস্টুরেন্টে দুজনে কথা বলছিলো । স্বপ্নার আজ কিছু অভিমানী ভাষায় তীব্র কথা অজয়কে ১৫ বছর পেছনে নিয়ে চলে গেল । অজয় যে আজ শুধু বোবার মতো বসে ছিল, তার যে বলার কিছু ছিল না…………
স্কুল ফাইনাল পরীক্ষার পর অজয়ের হাতে বেশ সময় ছিল, পাড়ার একজন অজয়কে বললো তাদের একটা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহন করতে হবে । অজয় কোন কিছু না ভেবে রাজি হয়েছিল । একটা গীতি-আলেখ্যর রিহার্সাল চলছিল, অজয় সেই রিহার্সালে যোগদান করল । দুদিন পর সেই রিহার্সালে স্বপ্না নামে একটি মেয়েও অংশগ্রহন করতে এল । সেও সদ্য স্কুল ফাইনাল পরীক্ষা দিয়েছিল । অজয়ের সাথে তার আলাপ হল । মেয়েটি পড়াশোনায় খুব ভালো, মেয়েটি তার স্কুলে দ্বিতীয় স্থান দখল করত । স্বাভাবিক ভাবেই অজয়ের মত সাধারন মেধার একটি ছেলের কাছে স্বপ্নার মতো একটি মেয়ের আলাপ হওয়া বিশাল ব্যাপার । কিন্তু স্বপ্না সত্যি খুব ভালো মেয়ে, খুব সহজে সকলকে খুব আপন করে নিতে পারত । ওর সাথে কথা বলে অজয়ের মনে হয়েছে স্বপ্নার যা মেধা ও প্রতিভা, ও ভবিষ্যতে অনেক দূর এগোবে । দুই মাসের মধ্যেই স্বপ্নার সাথে পরিচয় আস্তে আস্তে গভীর বন্ধুত্ত্বে পরিণত হল । কিছুদিন পরেই স্কুল ফাইনাল পরীক্ষার রেজাল্ট বেরোল, অজয়ের সাদামাটা রেজাল্টের পাশে স্বপ্নার উজ্জ্বল রেজাল্ট সকলের মন জয় করে নিয়েছিল । হীনমন্যতায় ভোগা অজয় নিজেকে দূরে সরিয়ে নিতে চেয়েছিল স্বপ্নার কাছ থেকে, কিন্তু কেন জানিনা স্বপ্না অজয়কে আঁকড়ে ধরে রেখেছিল । মূলতঃ স্বপ্নার জন্যই অজয়ের জীবন একটা নতুন রঙে রাঙিয়ে উঠেছিল । এরপর দুজনেই বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হয়েছিল, এক সাথে ওরা পড়াশোনা করত । ক্রমে ক্রমে ওরা একে অপরের পরিপূরক হয়ে উঠেছিল, ওদের বন্ধুত্ত্ব এক গভীর ভালোবাসায় রূপান্তর হয়ে উঠল, স্বপ্না অজয়কে নিয়ে জীবন গড়ার স্বপ্ন দেখতে শুরু করলো । কিন্তু অজয়ের কাছে এটা স্বপ্নের থেকেও বড় কিছু মনে হয়েছিল । সে স্বপ্নাকে তার মন–মন্দিরে বসিয়েছে । শুধু ভালোবাসা নয়, তাকে সে গভীর সম্মানও জানাতো । হয়তো কোন সময়ে দুজনের মধ্যে ঘনিষ্টতম মুহুর্ত তৈরী হয়েছিল, পরক্ষনেই অজয়ের মনে হয়েছে, যে তার কাছে একটা বিশেষ আসনে রয়েছে, তাকে জীবনসঙ্গিনী হিসাবে ভাবা ভীষণ অন্যায় । তার সাধারণ জীবন স্বপ্নার কাছে একটা অভিশাপ না হয়ে দাঁড়ায় । স্বপ্নার উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ যদি কালো অন্ধকারে হারিয়ে যায় । স্বপ্নার ছোঁয়ায় অজয় হায়ার সেকেন্ডারী পরীক্ষায় বেশ ভালো রেজাল্ট করেছিল । স্বপ্নাও যথারীতি আরো ভালো রেজাল্ট করে ওর বাবা-মাকে আরো গর্বিত করেছিল । কিন্তু জীবন গড়ার এই সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে অজয় স্বপ্নাকে বেশ হতাশ করেছিলো । অজয় নিজেকে স্বপ্নার থেকে দূরে সরিয়ে নিল । অজয়ের জীবন বাঁধাগতে চলতে থাকে । স্বপ্নাও বেশ সুন্দর ভাবে নিজের ভবিষ্যৎ জীবনকে গড়ে নিয়েছিল । পড়াশোনার পর্ব শেষ করে স্বপ্না একটা সরকারী অফিসে পদস্থ অফিসার হিসাবে যোগদান করেছিল । একজন হাই-প্রোফাইল ভালো ঘরের ছেলের সাথে বিয়েও হয়ে গিয়েছিল । অজয় একটা প্রাইভেট কোম্পানীতে চাকরি পেয়েছিল । ক্রমে ক্রমে সেও মোটামুটি ভাবে সংসার জীবন শুরু করেছিল । দুজনের জীবন সম্পূর্ণ নিজস্ব ধারায় বয়ে যাচ্ছিল ।
…… অজয়ের চোখের সামনে সব কিছু রূপোলী পর্দার সিনেমার মতো ভেসে উঠেছে সেই ফেলে আসা পুরনো জীবন । সেই যে মধুর ক’বছরের জীবন অজয়ের কাছে মহামূল্যবান । সে ভেবেছিল স্বপ্নাকে দূরে সরিয়ে দিয়ে তার ভালোই করেছিল । কিন্তু আজ এতদিন পর স্বপ্নার সাথে নিরালা রেস্টুরেন্টে বসে স্বপ্নার একটা কথা “আর ইচ্ছা হয় না তোমার সাথে কথা বলতে, কারন তুমি আমাকে রিফ্যুস করেছিলে, এটাই আমার বারে বারে মনে হয়”… তারপর চুপ হয়ে যায় স্বপ্না । অজয়কে এক বিরাট ধোঁয়াশার মধ্যে ফেলে সে বেরিয়ে যায় ।
Be the first to comment