কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় শঙ্কিত এলন মাস্ক

Spread the love

তপন মল্লিক চৌধুরী

বর্তমান বিশ্বের প্রযুক্তি জগতের প্রবাদ পুরুষ ধরা হয় এলন মাস্ককে। তিনি মহাকাশ ভ্রমণ সংস্থা স্পেসএক্স এবং বৈদ্যুতিক গাড়ির প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান টেসলা, নিউরোটেকনোলজির গবেষণা সংস্থা নিউরোলিংক, উচ্চ গতিসম্পন্ন পরিবহন ব্যবস্থার বোরিং কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা। উন্নত প্রযুক্তির মাধ্যমে বিশ্বকে বদলে দেওয়ার নানা উদ্ভাবনের জন্য প্রযুক্তির ‘বরপুত্র’ বলা হয় তাকে।

এলন মাস্ক বরাবরই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তির রোবট নির্মাণের বিরোধিতা করে আসছেন। তার মতে, এ ধরনের পদক্ষেপ হতে পারে ‘খাল কেটে কুমির আনা’।

এবার তিনি দাবি করেছেন, ‘কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তির ফলে আমরা আস্তে আস্তে রোবটদের নিয়ন্ত্রণে চলে যাবো, যা থেকে বের হয়ে আসা কোনোদিনও সম্ভব হবে না আমাদের।’ ক্রিস পাইন নির্মিত ‘ডু ইউ ট্রাস্ট দিজ কম্পিউটার?’ নামক ডকুমেন্টারিতে তিনি এ মন্তব্য করেন।

ডকুমেন্টারিতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তির সম্ভাব্য সুবিধা এবং চরম ক্ষতিকর দিকগুলো তুলে ধরা হয়। একনায়কতান্ত্রিক দেশগুলোতে এই প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে একসময় দেশগুলোর ক্ষমতা রোবটদের হাতে চলে যাওয়ার আশঙ্কা করেন মাস্ক এবং এর ফলে ভবিষ্যতে মানবতা এ সকল রোবটদের হাতে চরম নিপীড়ন এবং অত্যাচারের শিকার হবে বলে মন্তব্য করেন মাস্ক। সময়ের বিবর্তনে আমাদের তৈরি রোবটগুলো আমাদেরই শাসন করা শুরু করবে।

এলন মাস্ক কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তির কঠোর নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার কথা বলেন। তার মতে, একমাত্র কঠোর নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার মাধ্যমেই এই প্রযুক্তির অপব্যবহার থেকে মানবতাকে বাঁচানো সম্ভব। তাছাড়া এই প্রযুক্তির মাধ্যমে নির্মিত রোবটগুলো আমাদের জন্য মারাত্মক বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়াবে, যা আমাদের কল্পনার বাইরে। ভবিষ্যতে পরিস্থিতির বশবর্তী হয়ে আমরা যদি রোবটদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যাই, সেখানে ৫-১০ শতাংশেরও কম আমাদের সফলতার সম্ভাবনা রয়েছে; কেননা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন রোবটগুলো অত্যন্ত শক্তিশালী হবে। এই প্রযুক্তি নিয়ে সচেতনতা তৈরি হলে মানুষ এই প্রযুক্তি সম্পর্কে সঠিক ধারণা নিয়েই এটাকে ব্যবহার করবে ফলে বিপদের মাত্রা অনেকাংশে কমে যাবে।

সাধারণত যেটা ঘটে সেটা হচ্ছে, কোনো একটা বিপদ বা ঘটনা ঘটে যাওয়ার পরে গণসচেতনতামূলক নানান কার্যক্রম হাতে নেওয়া হয়, মানুষের ভোগান্তির পরে ব্যবস্থা গ্রহণের প্রসঙ্গ আসে। কিন্তু এক্ষেত্রে যদি পরের কাজ পরে বলে যদি আমরা নিশ্চিন্ত থাকি তাহলে ভবিষ্যতে আমরা রোবটের দাসে পরিণত হব। চরম কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং শক্তির অধিকারী রোবট দানব আমাদের নিয়ন্ত্রণ করে শুরু করবে, যা মানবতার নির্মম এক পরিহাসে পরিণত হবে।

প্রতিটি দেশেরই উচিত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তি ব্যবহারে সচেতন হওয়া এবং এটি সম্বন্ধে স্বচ্ছ জ্ঞানের মাধ্যমে কঠোর নিরাপত্তাসহ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা গড়ে তোলা। এলন মাস্ক এটাও বলেন, উত্তর কোরিয়ার একটিবিশ্ববিদ্যালয়ে অত্যাধুনিক কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন রোবট নিয়ে গবেষণা চলেছে এবং তারা গোপনে রোবটিক সৈন্য নির্মাণ করছে যা মানবতা ধ্বংসের পথে নিয়ে যেতে পারে।

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রযুক্তির বিপজ্জনক দিকগুলো নিয়ে বেশ কয়েক বছর ধরেই সোচ্চার এলন মাস্ক। বিভিন্ন সময়ের তার কিছু মন্তব্য এখানে তুলে ধরা হলো-

* আগস্ট ২০১৪ :‘আমাদের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তির ব্যাপারে আরো সচেতন হতে হবে, কেননা পারমাণবিক অস্ত্র থেকে এটি আরো বেশি বিপজ্জনক।’

* অক্টোবর ২০১৪ :‘আমাদের অস্তিত্বকে ঝুঁকিতে ফেলার মতো প্রযুক্তি হচ্ছে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তি। আমরা এই প্রযুক্তির মাধ্যমে শয়তানের প্রকোপকে পৃথিবীতে ডেকে আনছি।’

* জুন ২০১৬ :‘অত্যাধুনিক কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তির ফলাফল হিসেবে আমরা এই প্রযুক্তির বা এই প্রযুক্তিতে তৈরি রোবটদের দাস বা পোষা প্রাণীতে পরিণত হব।’

* জুলাই ২০১৭ :‘কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তি মানবসভ্যতার জন্য খুবই বিপজ্জনক এবং এবং এই বিপদ এড়াতে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থার মাধ্যমে এই প্রযুক্তি ব্যবহার করা উচিত। আমি প্রতিনিয়িত এই প্রযুক্তির নানারকম উন্নয়ন এবং নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করে যাচ্ছি এবং আমি মনে করি জনগণের এটা নিয়ে সচেতন হওয়া উচিত। আমি যতই সতর্কতামূলক কথা বলি না কেন, রোবটগুলো যখন মানুষ মারা শুরু করবে তখন মানুষজন এটার প্রভাব বুঝতে পারবে, কেননা আসলে কি ঘটতে চলেছে তা এই মুহূর্তে কল্পনা করা বেশ কঠিন।’

* আগস্ট ২০১৭ :‘কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তির ব্যাপারে আমাদের কঠোর সচেতনতা অবলম্বন করা উচিত, কেননা এটি উত্তর কোরিয়া থেকেও বেশি বিপজ্জনক।’

* নভেম্বর ২০১৭ :‘কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তি নিরাপদ করার ক্ষেত্রে ৫-১০ শতাংশ সম্ভাবনা রয়েছে।’

* মার্চ ২০১৮ :‘কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তি পারমাণবিক অস্ত্রের থেলেও মারাত্মক। সুতরাং কেন এটার জন্য কোনো নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা থাকবে না?’

* এপ্রিল ২০১৮ :‘এই প্রযুক্তিটি খুবই গভীর একটি বিষয় এবং এটি এমনভাবে আমাদের জীবনকে ঝুঁকির মুখে ঠেলে দিতে যাচ্ছে, যা বর্তমানে কল্পনা করা প্রায় অসম্ভব।’

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তি নিয়ে দুশ্চিন্তার কারণ

বর্তমান বিশ্বে এই প্রযুক্তি এমন পর্যায়ে গেছে যা, শুধুমাত্র এলন মাস্ক নয়, বিল গেটসের মতো ব্যক্তিত্বকেও চিন্তিত করে তুলেছে। মাস্কের মতে, এই প্রযুক্তি আমাদের অস্তিত্বকে সংকটাপন্ন করে তুলবে এবং পৃথিবীকে নিয়ে যাবে ধ্বংসের পথে। তিনি বিশ্বাস করেন, বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন যন্ত্রগুলো মানুষকে তাদের পোষা প্রাণীতে পরিণত করবে।

তাছাড়া অধ্যাপক স্যার স্টিফেন হকিং বলে গেছেন, আগামী ১,০০০ থেকে ১০,০০০ বছরের মধ্যে প্রযুক্তিগত দুর্যোগ মানুষের অস্তিত্বের জন্য চরম ঝুঁকি বয়ে আনবে।

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন রোবট কি ধরনের সংকট তৈরি করতে পারে তারই সামান্য নমুনা এখানে তুলে ধরা হল:

* কর্মসংকট সৃষ্টি করবে : ২০১৬ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে, বিশ্বের ৬০ শতাংশ মানুষ মনে করে আগামী দশ বছরে এই রোবটের কারণে তাদের কাজের অভাব ঘটবে। তাছাড়া ২৭ শতাংশ মানুষ এটা মনে করেন যে, তারা মানুষের জন্য কাজের সংখ্যা কমিয়ে ফেলবে যার ফলে মানুষের জীবনমান হয়ে পড়বে বিপন্ন। অন্যান্য গবেষকগণ মনে করেন, এই ধরনের রোবটগুলো জটিল থেকে জটিলতর হয়ে বিজ্ঞানীদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। এছাড়াও আশঙ্কা করা হয় যে, আগামী ১১ থেকে ২০ বছরের মধ্যে রোবট আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অংশ হয়ে দাঁড়াবে। অনেক গবেষক মনে করেন, আগামী দশকেই রোবটের আধিপত্য দেখা যাবে পৃথিবীতে।

* তারা নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে যেতে পারে :  কম্পিউটার বিজ্ঞানী অধ্যাপক মাইকেল উলড্রিজ বলেন, এই ধরনের রোবটগুলো জটিল থেকে জটিলতর হয়ে যেতে পারে যার ফলে তারা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে, যার ফলে বিজ্ঞানীরা তাদের আয়ত্তে রাখতে পারবে না। আসলে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন রোবটগুলোর প্রোগ্রামিং অত্যন্ত জটিল যার কাছে বিজ্ঞানী এবং গবেষকগণ প্রায়শই হার মানেন। তাই তাদের আয়ত্তের বাইরে যাওয়ার সম্ভাবনা ব্যাপক। সুতরাং চালকবিহীন গাড়ি বা বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন রোবটগুলো সংকটাপন্ন সময়ে উল্টাপাল্টা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলতে পারে, যা খুবই বিপজ্জনক। চালকবিহীন গাড়িগুলোর দ্বারা মানুষের মতো বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে গাড়ি চালানো প্রায় অসম্ভব, যার ফলে দুর্ঘটনার হার বাড়ার সম্ভাবনা বেড়ে যাবে।

* মানুষের অস্তিত্ব বিলীন করে দিতে পারে : কিছুসংখ্যক মানুষ মনে করেন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন রোবট মানুষের অস্তিত্বকে বিলীন করে দেবে। তাছাড়া অনেক গবেষক মনে করেন, মানুষের অস্তিত্ব একদিন ঠিকই বিলীন হবে এবং প্রযুক্তি এক্ষেত্রে একটি হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হবে। এই শতাব্দীর শীর্ষ ঝুঁকি হিসেবে কিছু গবেষক কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তিকে দায়ী করে থাকেন।

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*