প্রশান্ত কুমার ঘোষ –
আজ আমরা ফেসবুকের তরঙ্গে স্নাত হয়।তার সৈকতে খুঁজে নিই নিজেদের নতুন ঠিকানা।হতাশার বালুচরে যখন লুটোপুটি করি তখন ফেসবুক দুহাত বাড়িয়ে অপেক্ষা করে এক চিলতে শান্তির জোছনা ধারায় ভেজানোর জন্য।ফেসবুক আজ ঘটক ঠাকুরের মতোই চার হাত এক করে,পুরাতন ছেঁড়া কাটা সম্পর্ক জুড়ে দেয়,বিভিন্ন মানুষের মধ্যে মিলন ঘটানোর জন্যই মেলা প্রাঙ্গনের মতো চিৎ হয়ে শুয়ে অপেক্ষা করে। যারা কথা বলতে পারেনা,কথা শুনতে পায়না তাদেরও কথা বলিয়ে সকলকে এক করে দেয়। এই ফেসবুকের একটি অতি জনপ্রিয় ফিচার বৃদ্ধাঙ্গুলি।
প্রাচীন কালে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখালে বুঝত কাঁচকলা খাও।কাওকে অবহেলা বা অমান্য করা বা কোন কাজে অসম্মতি বোঝাতেও বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানোর রেয়াজ ছিল।শুধু তাই নয় কোন কাজে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখালে জুটত ভৎসনা, ঝগড়াঝাটি, মারপিট ইত্যাদি।আমি তখন ছোট,মা আমাকে জলের মগ আনতে বলে ছিল।আমি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ছিলাম।মা বলেছিল স্কুল থেকে ফিরে খিদের তপ্তে সেদ্ধ হয়ে খাবি খেতে খেতে যখন বলবি মা আমাকে দারুন খিদে পেয়েছে তখন যদি তোর ঔ বৃদ্ধাঙ্গুলি ফেরত দিই তখন তোর কতটা কষ্ট হবে সেটা কি জানিস? আমি আর কোন কথা না বলে মায়ের নির্দেশ পালন করেছিলাম।
সময়ের স্রোতে সব কিছুই পরিবর্তন হয়।বৃদ্ধাঙ্গুলির ক্ষেত্রেও এই নিয়মের ব্যতিক্রম হয়নি।বৃদ্ধাঙ্গুলি আজ বেশ আধুনিক সাজে সজ্জিত।এখন তার ইমোজি চিহ্ন মানেই “সব ভাল ” বা “আমি পছন্দ করি”‘,”বাহ”, “আমি ভালো আছি”, “আমি সমর্থন করি”,”আমি ঠিক আছি”ইত্যদি।
বৃদ্ধাঙ্গুলির পোশাকি নাম লাইক।এর ইমেজ এখন সকলের হৃদয়ের চিলেকোঠায় স্থান পেয়েছে।ফেসবুক,ম্যাসেঞ্জার,হোয়া টস আ্যপে কোন কিছু পোস্ট করে তাকিয়ে থাকি কখন বৃদ্ধাঙ্গুলী উটের মত ঘাড় তুলে আসে।অনেকক্ষেত্রে এই লাইকই অসহায় মরুভূমিময় মনুষের জীবনে বয়ে আনে এক চিলতে মেঘ, যা বৃষ্টি আনে, আনে সবুজ শষ্য শ্যামল সোনার জীবন।
ছত্রিশগড়ের বিলাসপুরের শুভেন্দু সাহা মূক ও বধির।প্রতিবন্ধী হয়েও অদম্য জীবনীশক্তিতে ভরপুর।সুদর্শন শুভেন্দু বিএ পাশ করে বাবার সাথে মুদিখানা চালাতে থাকে।মনের কথা বলতে না পেরে একপেশে জীবন অতিবাহিত করতে থাকে শুভেন্দু।অবসাদের হাত থেকে স্বাদ ছিনিয়ে নিতেই হাতে রাখলো এন্ড্রয়েড ফোন।ফেসবুক, ম্যাসেন্জার আর হোয়াটস আ্যপে সকলের সাথে মনের কথা লিখে জীবন তরী পার করতে থাকে সে।নেটের স্রোতে এগিয়ে যেতে যেতেই পেয়ে যায় সবুজ দ্বীপের সন্ধান।
সবুজ দ্বীপটির নাম তুলসী শর্মা। পশিমবঙ্গের বীরভূমের ঈশ্বরপুরের এই দ্বীপটিও কথা বলতে পারেনা,শুনতে পায়না।অতি দারিদ্রতার মধ্যেও তুলসীর বাবা কলকাতার স্কুলে উচ্চমাধ্যমিক পড়িয়েছেন।উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে বাড়ির কাজ করেন।বাবা মায়ের চিন্তা মেয়ের ভবিতব্য কি হবে? বিয়ে হবে না ভেবে বাড়িতেই ছোট ওয়েল্ডিং মেশিন বসিয়ে তুলসীকে ব্যবসায় নামিয়ে দেয় তার পরিবার৷
চিন্তার ভাঁজে তুলসী।ভাঁজের মোচড়ে যাতে মুচড়ে না যায় তার জন্য তাঁকে একটা মোবাইলও কিনে দেয় তার বাবা।হাতের আঙ্গুলে দুনিয়া।নেটের জোয়ারেই ভেসে আসে নব নব তরঙ্গ।শুভেন্দুর বন্ধুত্বের সুশীতল ছায়ায় আশ্রয় নেয় তুলসী।প্রথমে পরস্পর পরস্পরের বিভিন্ন পোস্ট ও ছবিতে লাইক,তারপর কমেন্ট ও তার প্রত্যুত্তর।উত্তর আর প্রত্যুত্তরের মাঝে একটা স্বস্তির হিমেল বাতাস।বাতাসের পলে পলে ভালোলাগার ঝর্না।ঝর্নার হাতে হাত রেখেই শুরু চ্যাট।চ্যাটের সিন্দুকে দুটি মনের লিবিডো এক হয়ে যায়।
নদীর জল যেমন উপচে উঠে পার্শ্ববর্তী এলাকা ভরিয়ে তোলে তেমনি দুটি হৃদয়ের বাঁধভাঙা উচ্ছাস ফেসবুক ছাড়িয়ে মেসেঞ্জারে প্রবেশ করে। শুরু হয় ভিডিও কল।শুভেন্দু সুদর্শন ও সুঠাম। আর তুলসী সুশ্রী ও সু নয়না।দুজনেই মনের
মগডালে বসে প্রকৃতির অপরূপ সৃষ্টির বারিধারায় পেখম তুলে নাচতে থাকে।তবে কথা না বলতে পারায় পারস্পরিক অনুভূতির আদানপ্রদান হয় অঙ্গভঙ্গি ও অক্ষরের মাধ্যমে। দুজনের ভিডিও সাক্ষাৎ মনের অদম্য সাহস বাড়িয়ে তুলে।নদীর জলরাশি যেমন মোহনা গিয়ে একাকার হয় তেমনি দুটি হৃদয় নেটের মোহনায় মিলেমিশে এক হয়ে যায়।এক তরকারিতে মন ভরেনা তাই মেসেঞ্জারের কার্নিশ বেয়ে হোয়াটস আ্যপে রাজত্ব শুরু হয়।আরও কাছাকছি আসা।নেটে ধরা পড়ে দুটি হৃদয়ের একাত্মতা,শুরু হয় ভালোলাগা, ভালোলাগার গলিপথ ধরেই ভালোবাসার রাজপথে আসা।রাজপথ ধরেই স্বর্গীয় আহ্বানে সাড়া দেয়া।
ফোনের কিবোর্ড আঙ্গুল দিয়েই ভালোবাসার ফিতে কাটা শুরু হয়। মনের কথা অক্ষর টাইপে আর সীমাবদ্ধ থাকতে চাইনা। মনের গিরিতটে উঁকি দেয় রক্তিম উষ্ণ ঊষা।ঊষার আঁচলে বাকি দিনগুলো অতিবাহিত করলেই জীবনের স্বার্থকতা। শুভেন্দু বাড়িতে সব জানায়।মনের দরজায় কড়া নাড়া পছন্দ করেননি শুভেন্দুর বাবা সুভাষ বাবু। অতিথি বাৎসল্য মন নিয়েই যোগাযোগ করেন তুলসী শর্মার বাড়িতে।ফোনের আলাপে মুগ্ধ হন তুলসীর বাবা জয়ন্ত শর্মা।সুভাষ বাবুর কলিং বেলের শব্দে দরজা খুলেন শর্মা বাবু।
সুভাষ বাবুর পরিবার জয়ন্ত বাবুর বাড়িতে এসে আপ্লুত হয়ে উঠেন।ভক্তি ও ভালোবাসার উচ্ছাসে হারিয়ে যায় পাত্রপক্ষ।সুভাষ বাবু বলেন,আমরা তো আসলাম, আপনারাও চলুন।হৃদয় উজাড় করা আমন্ত্রন হাতছাড়া করেননি শর্মা পরিবার।তুলসীর বাবা-মা শুভেন্দুর বাড়ি গিয়ে পাকা কথা কয়ে নেন।
বর-কনে কথা বলতে পারে না। তাই শুধু পুরোহীতের মন্ত্রপাঠের মধ্য দিয়েই শুরু হয় চার হাত এক করার পর্ব।তারপর সাতপাক ঘোরা, মালা বদল, সিঁদুর দান ইত্যাদি মাঙ্গলিক কর্ম সুন্দর ভাবেই সম্পন্ন করেন প্রেমিক যুগল।অবশেষে দুই নদী এক হয়ে কুলকুল করে বয়ে চলে উচ্ছল জলধিত রঙ্গের হৃদয়ের উপর দিয়ে।
Be the first to comment