তপন মল্লিক চৌধুরী : একটি বাড়ির নিচের তলায় গানের স্কুল আর ওই বাড়ির তিনতলার ভাড়াটিয়া পরিবারের সর্বকনিষ্ঠা সদস্যা সকাল-সন্ধ্যায় করে রেওয়াজ। একদিন গানের স্কুলের অতিথি হয়ে হাজির হয়েছিলেন সেকালের হিন্দি ছবির সংগীত পরিচালক হনুমানপ্রসাদ। সেই সময় তিনতলায় হারমোনিয়াম বাজিয়ে গলা সাধছিল ওই কিশোরী। তার সুরেলা কণ্ঠের প্রভাবে বেশ খানিকটা নাড়া খেয়েই মুগ্ধ হন যে তার ‘ভক্ত প্রহ্লাদ’ ছবিতে ওই কিশোরীর কণ্ঠ ব্যবহার করতে বাধ্য হলেন। এইভাবেই ১৯৪৬ সালে সিনেমার গান গেয়েই সংগীতজীবনের যাত্রা শুরু হয়েছিল গীতা রায়ের। পরবর্তীতে তিনি জনপ্রিয় সংগীতশিল্পী গীতা দত্ত। সুরাইয়া পরবর্তী প্লে-ব্যাক সিঙ্গারদের মধ্যে তাঁর জনপ্রিয়তা যে শীর্ষস্থানে ছিল তার কারণ একেবারে অন্যরকমের কণ্ঠস্বর এবং গায়কী। কণ্ঠে এমন মায়া এবং ছায়ার সমারহ সচরাচর মেলে না। অনেকটা ধুমকেতুর মতো তিনি হিন্দি ও বাংলা গানের জগতে হাজির হয়েছিলেন, মায়াবী কণ্ঠের জাদুতে শ্রোতাদের বশও করেছিলেন কিন্তু বিদায়বেলা খুব দুঃখজনক পরিস্থিতিতেই কেটেছিল গীতা দত্তর। ‘ভক্ত প্রহ্লাদ’ ছবির একটি গানের কয়েক কলি গাওয়ার সূত্রে এক বছরের মধ্যে তিনি আধ ডজন ছবিতে গান গাইবার সুযোগ পেয়েছিলেন। যদিও সেসব গান-এর কোনওটাই তাঁর হিট গানের তালিকায় ঠাঁই পায় না। কিন্তু স্বয়ং শচীন দেববর্মণও তাঁর কণ্ঠের জাদুতে মজে গেলেন। ১৯৪৭-এ মুক্তি পাওয়া ‘দো ভাই’ ছবিতে সংগীত পরিচালক হিসেবে শচীন দেববর্মণ আর ‘সুন্দর সপনা বীত গয়া’ প্রভৃতি গানের জন্য গীতা দত্ত পৌঁছে গেলেন মুম্বাই সিনেমা দুনিয়ার শীর্ষস্থানে।
বাংলাদেশের ফরিদপুরের জমিদার দেবেন্দ্রনাথ রায়চৌধুরীর মেয়ে গীতা ৪২-এর ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনের ধাক্কায় স্বভূমি ছেড়ে মুম্বাই চলে আসতে বাধ্য হয়েছিলেন। লতা মঙ্গেশকরের বিপুল জনপ্রিয়তার আগে পর্যন্ত গীতা দত্তই ছিলেন প্লে-ব্যাকের রানি। ১৯৫১-তে ‘বাজি’ ছবির সূত্রে সেই শচীন দেববর্মণের সুরে ফের তুমুল হইচই। ‘তদবির সে বিগড়ি হুয়ি তকদির বনালে’, ‘শূন্যে গজর ক্যা গয়ে’, ‘ইয়ে মৌন আয়া কি মেরে দিল কি দুনিয়া মে বাহার আয়ি’। এবার গীতার গানে মুগ্ধ হয়ে প্রেমে পড়লেন গুরু দত্ত। তাঁর ‘আসমান’ ছবিতে স্বভাবতই প্রধান গায়িকা নির্বাচিত হলেন গীতা। এবার সংগীত পরিচালক ও পিনাইয়ার। ওঁর সুরে অবশ্য গীতা বরাবরই ঝলসে উঠেছেন কিন্তু গুরু দত্তর ‘আসমান’ ছবি ফ্লপ করল, হিট করল গীতার গাওয়া ‘দিল হ্যায় দিওয়ানা’, ‘দেখো জাদু ভরে মোরে নেন’। গীতা নতুন করে নিজেকে হাজির করলেন শ্রোতাদের সামনে। অনেকেই এ ছবির ব্যর্থতায় গীতা আর গুরু দত্তর সম্পর্কের পরিণতির ভবিষ্যৎ দেখতে শুরু করেছিলেন। কারণ পরবর্তী ছবি ‘রাজ’ বাণিজ্যিকভাবে সফল হয়নি যদিও ও পি নাইয়া-এর সুরে গীতার ‘অ্যায় দিন অ্যায় দিওয়ানে’, ‘জরা সামনে আ জরা আঁখ মিলা’ হিট করেছিল। বিপুল জনপ্রিয়তা পেয়েছিল ‘আর পার’ ছবির গান। লোকের মুখে মুখে ফিরেছে ‘বাবুজি ধীরে চল না’, ‘আভি ম্যায় জওয়ান’, ‘ইয়ে লো ম্যায় হারি পিয়া’, ‘শুন শুন জালিমা’। ফের ও পি নাইয়ার-এর সুরে ‘মিস্টার অ্যান্ড মিসেস ফিফটি ফাইভ’ ছবিতে রফির সঙ্গে গীতার ‘জানে কঁহা মেরা জিগর গয়া জি’, ‘উধর তুম হাসিন হো’ এবং একক ‘প্রীতম আন মিলো’, ‘নীলি আসমান’ বিপুল সাড়া ফেলেছিল। একই সঙ্গে আলোড়ন তুলেছিল ‘হাওড়া ব্রিজ’ ছবির ‘মেরা নাম চিন চিন চু’।
এরপর গীতা আর গুরু দত্তর প্রেম দাম্পত্যে পরিণতি পায়। গুরু দত্ত তখনও নিজেকে সুপ্রিতিষ্ঠিত করার লড়াই চালাচ্ছেন। ইতিমধ্যে গীতা নিজেকে কেবল প্রতিষ্ঠিতই করেননি, প্লে-ব্যাক সিঙ্গার হিসেবে জনপ্রিয়তার শীর্ষে উঠে পড়েছেন। কিন্তু খুব বেশি দিন না গড়াতেই দাম্পত্য জীবনের পথ বেশ খানিকটা মনস্তাত্ত্বিক বাঁক নেয়। উভয়ের জীবনযাত্রা আরও খানিক জটিল হয়ে ওঠে গুরু দত্ত-র ফরমানে—তাঁর ছবি ছাড়া গীতা অন্য কোথাও গান গাইতে পারবেন না। ইতিমধ্যে তিন সন্তানের জন্ম হয়েছ। গীতাকেও মায়ের ভূমিকায় সক্রিয় হয়ে উঠতে হয়। অন্য দিকে গুরু দত্তর ছবি বাণিজ্যিক সফলতা পেতে শুরু করে। গীতা কিন্তু মনেপ্রাণে একা হয়ে পড়েন। কিছুটা অসহায়ও বোধ করতে শুরু করেন। কিন্তু এই অসহায়তা মেনে নিতে পারবেন না বলেই স্বামীকে না জানিয়ে ফের রেকর্ডিং স্টুডিওতে যাতায়াত শুরু করেন। স্বামীকে না জানিয়ে রিহার্সাল, রেকর্ডিং। স্বামী বাড়ি ফেরার আগে ফিরে আসা—এইভাবে চোর-পুলিশ খেলার ফাঁকে বেশ কিছু গান হিট করে গেলেও গীতার সময় নিয়ে বাধ্যবাধকতা সংগীত পরিচালকরা ঠিক মেনে নিতে পারলেন না। সন্ধ্যে হওয়ার আগে ফেরার তাড়ায় গীতার গানে মন থাকে না, কাজও সম্পূর্ণ হয় না। শচীন দেববর্মণ, ও পি নাইয়ারের প্রিয় শিল্পীর জায়গা এভাবে একদিন দখল করে নেন লতা মঙ্গেশকর ও আশা ভোঁসলে। একদিকে দাম্পত্য সংকট, অন্যদিকে স্বামীকে না জানিয়ে গীতার গান গাওয়া—শেষ পর্যন্ত অন্য বাঁকে মোড় নেয়। গুরু দত্ত বেগতিক বুঝে গীতাকে নায়িকা করে ‘গৌরী’ ছবির কাজ শুরু করেন। গীত ফের স্বপ্নের ডানায় ভর করে উড়তে থাকেন কিন্তু সেই স্বপ্ন ভেঙে যায় যেদিন স্টুডিওতে স্বামীর প্রেমিকা তারকাকে আবিষ্কার করেন। সন্তানদের দায় মিটিয়ে গীতা আশ্রয় নেন অ্যালকোহলে। ক্রমশ অসুস্থ হয়ে পড়া প্লে-ব্যাক তারকার জীবনে নেমে আসে আর্থিক সংকট। গুরু দত্ত ততদিনে বেছে নিয়েছেন আত্মহননের পথ। সংগীত পরিচালকদের দরজায় দরজায় ঘুরেছেন কাজের জন্য। স্টেজে গান গাইবার জন্য খুঁজেছেন সুযোগ। কিন্তু ততদিনে কেবলই স্মৃতি হতে থাকে ‘সিআইডি’ ছবির ‘আঁখো হি আঁখো মে ইশারা’, ‘শর্ত’ ছবির ‘না ইয়ে চাঁদ হোগা’, ‘মুনিমজি’ ছবির ‘দিল কি উমঙ্গ হ্যায় জওয়ান’, ‘পিয়াসা’ ছবির ‘জানে কা তুনে কহি’, ‘কাগজকে ফুল’ ছবির ‘ওয়াক্ত নে কিয়া হসিন সিতম’, ‘সুজাতা’ ছবির ‘বচপন কে দিন ভি ক্যা দিন থে’, ‘চৌধবি কা চাঁদ’ ছবির ‘বালম মে মিলন হোগা’, ‘পৃথিবী আমারে চায়’ ছবির ‘নিশিরাত বাঁকা চাঁদ আকাশে’, ‘হারানো সুর ছবির ‘তুমি যে আমার’, ‘হসপিটাল’ ছবির ‘এই সুন্দর স্বর্ণালী সন্ধ্যায়’, সাথীহারা ছবির ‘বাঁশি বুঝি সেই সুরে’ প্রভৃতি কালজয়ী গান। রোজগারের আশায় ছুটতে ছুটতে ক্লান্ত, অবসন্ন গীতা ঝিমিয়ে পড়েন মাত্র চৌত্রিশ বছর বয়সেই, অবশেষে অকালে স্তব্ধ হয়ে যায় কিন্নরকণ্ঠীর প্রাণস্পন্দন।
Be the first to comment