কৃষ্ণকলি
আজ দোল। পূর্ণিমার আলোয় মাখামাখি তৃণা আর রঙ্গনের বিছানা। দুজনে পাশাপাশি, কিন্তু অদ্ভুত ভাবে নিশ্চুপ। আজ আবিরের জন্মদিন। আবির তৃণার ছোটবেলার বন্ধু। ছুটিতে যখন মামাবাড়ি যেত, আবির ছিলো তার সঙ্গী। এত ভাব দেখে মিষ্টিমাসি মানে আবিরের মা এবং তৃণার মা ঠিক করে দুজনে যেন চিরসঙ্গী হয়। আবিরের বাড়ি পূর্ব মেদিনীপুরের কাঁথিতে। স্কুলে কখনও সেকেন্ড হয়নি আবির। তৃণাও কম কিছু নয়। কলকাতার নামকরা স্কুলে স্ট্যান্ড করে।
উচ্চমাধ্যমিকের রেজাল্টে র্যাঙ্ক করে আবির। তৃণাও কমার্সে ভালো রেজাল্ট করে। ভর্তি হয় গোয়েঙ্কা কলেজে। আর আবির জয়েন্ট ও এইমস এর এন্ট্রান্সে ভালো ফল করে। দিল্লি এইমস্ এ চান্স পায় আবির। তৃণা-আবীর দুই পরিবারে তখন বাঁধ ভাঙা খুশি। আবিরের দিল্লি যাওয়ার দিন। তৃণাদের বাড়ি থেকেই সবাই মিলে গেলো হাওড়া স্টেশনে। রাজধানী ছাড়ল। সকলের চোখ তখন ভিজে। আনন্দে। দিল্লি পৌঁছে রোজই তৃণাকে ফোন করে আবির। দুবেলাই। হঠাৎ ফোন করা কমে যায় আবিরের। পড়ার চাপ বলে আবির।
সেদিন ছিলো তৃণাদের কলেজের ফ্রেশার্স ওয়েলকাম। মনটা ভালোই ছিলো। কলেজ থেকে ফিরে বারবার মনে পড়ছিলো আবিরের কথা। ফোন করলে পাছে বিরক্ত হয়, তাই করলো না। একটু বাদে তৃণার বাবা এলেন তার রুমে। গম্ভীর গলায় শুভময় বাবু বললেন, খারাপ খবর আছে। মনকে শক্ত করো। পৃথিবীটা যেন দুলে উঠলো। বাবা আস্তে আস্তে বললেন আবির নেই। কলেজ থেকে বলেছে সুইসাইড। নোটও পাওয়া গেছে। কিন্তু কেন? কাটাছেঁড়া, নাড়াঘাঁটা অনেক হলো। মৃত্যুর কারণ বেরিয়ে এলো কলেজের পরিবেশের সঙ্গে মানাতে না পেরে হতাশা, অবসাদ। আর সেখান থেকেই মৃত্যু। জীবনের সব রং সাদাকালো হয়ে যায় তৃণার। এই রকমই চলে বছর দুই।
কলেজ এক্সকারসানে সিমলা যাচ্ছে ব্যাচমেটরা। তৃণা আগেই না বলেছে। দোলের ছুটিতে যাচ্ছে। আর দোলেই তো আবিরের জন্মদিন। হঠাৎই মা আর মিস্টি মাসির চাপে সিমলা যেতে হয়। ভেবে দেখে এখানে থাকলে তো শুধুই আবিরের স্মৃতি। দোলের দিন তারা মানালিতে। হোটেল থেকে বেরিয়ে বিয়াসের পাড়ে বসেছে তৃণা। বন্ধুদের রং খেলার সুযোগ করে দিতেই বেরোল। ওকে রং লাগায় কারো সাধ্য নেই। আর ও থাকলে কেউ রং খেলবেও না। সন্ধে নামবে নামবে করছে। গোধূলি। হঠাৎই দেখে রঙ্গন পাশে। ওর কলেজের ব্যাচমেট। একটু আবির দেবো? এত স্পর্ধা তোর! চেঁচিয়ে ওঠে তৃণা। তোর আবির তোকেই দিচ্ছি। আবির তো চেয়েছিলো তোকে সারাজীবন রঙীন করতে। শান্তকণ্ঠে বলে রঙ্গন। সেদিন রং নেয়নি। কিন্তু মা বিশেষকরে মিস্টিমাসির জেদাজেদিতে রঙ্গনকে মেনে নেয় সে। তখন রঙ্গন এম বি এ করতে লন্ডন যাচ্ছে। কথা ছিলো ফিরলে বিয়ে হবে। রাজী হননি মিস্টিমাসি। নিজে দাঁড়িয়ে রঙ্গনের সঙ্গে বিয়ে দেন তৃণার। বলেন ওতো আমার আবিরেরই রং। তাই দোলে কাউকে রং দিতে না দিস, রঙ্গনের কাছ থেকে অবশ্যই রং নিবি।
আবির চলে গেছে দশ বছর হয়েছে। আজ আবার দোল। লাল আবির দিয়েছে রঙ্গন। চাঁদের আলোয় বড় মায়াময় লাগছে দুজনকে।
Be the first to comment