সুরের পরিবেশের মধ্য দিয়ে তাঁর বড় হয়ে ওঠা। বাড়িতে দিনরাত বেজে চলেছে আব্বাসউদ্দিন, শচীন দেববর্মণ-এর মতন বিখ্যাত শিল্পীর গান।সুর শোনার পাশাপাশি কথার প্রতি মনযোগী ছিল ছেলেটি ছোট বয়স থেকে। সেদিনের সেই সব গানের কথা, ছন্দের গঠন কোন্ অবচেতন মনেই তাঁর মনের গহ্বরে প্রবেশ করে গিয়েছিল। ছোট বয়স থেকেই কবিতা লিখতে শুরু করেন তিনি। ধীরে ধীরে সেদিনের সেই ছেলে পরবর্তী কালে কথার জাদুতে বাংলায় সুর রসিকদের মনকে মোহিত করে তুলেছিলেন। তিনি গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার। আধুনিক বাংলা গানের এক উজ্জ্বলতম জ্যোতিষ্ক।
১৯২৫ সালে পাবনায় জন্ম গৌরীপ্রসন্নের। বাবা খ্যাতনামা অধ্যাপক গিরিজাপ্রসন্ন মজুমদার। প্রাচীন ভারতে উদ্ভিদবিদ্যা ও কৃষিবিদ্যা নিয়ে গবেষণার জন্য সংস্কৃত পুঁথি থেকে তথ্য সংগ্রহ করতেন। মা সুধা মজুমদার ছিলেন সেই সময়ে স্নাতক। কবিতা ও প্রবন্ধ লেখার প্রতি ছিল তাঁর অসীম আগ্রহ। অতি অল্প বয়স থেকে গৌরীপ্রসন্নের হাতের নাগালে ছিল দেশি-বিদেশি বই। বাড়িতে ছিল বাংলা, ইংরেজি, সংস্কৃত ভাষার চর্চা। ছাত্র জীবনের গণ্ডি পেরোনোর আগেই ইংরেজিতে অনুবাদ করে ফেললেন কালীদাসের ‘মেঘদূতম’।
ছোট থেকেই এক মহান শিল্পীর কণ্ঠ বিশেষ আকর্ষণ করত কিশোর গৌরীপ্রসন্নকে। কলেজে পড়াকালীন একটা গান লিখে সটান চলে গেলেন শচীন দেব বর্মনের বাড়ি। লেখা দেখে পছন্দ হল শচীন কর্তার। গান গাওয়ার সম্মতি জানিয়ে তিনি গৌরীপ্রসন্নকে গানটা আকাশবাণীতে পৌঁছে দিতে বলেন। যুবক গৌরীপ্রসন্নের কাছে এটা ছিল স্বপ্নাতীত। রেডিয়োয় তাঁর লেখা গান শচীনকর্তা গাওয়ার পরে সাহস কিছুটা বাড়ল। এ বার রেকর্ডিংয়ের জন্য অনুরোধ করলেন গৌরীপ্রসন্ন। রাজি হলেন শচীনকর্তা। তবে তিনি জানালেন একটা নয়, ছ’খানা গান রেকর্ড করবেন। সারা রাত জেগে গান লিখলেন।
পরের দিন গানের কথা দেখেই নাকচ করে দিলেন শচীন। হতাশায় প্রায় ভেঙে পড়লেন সদ্য গীতিকবি হওয়ার স্বপ্ন দেখা গৌরীপ্রসন্ন। অবস্থা অনুধাবন করে একটা সুর শুনিয়ে বললেন, এর উপরে কথা বসাতে। হতাশা ভুলে গৌরীপ্রসন্ন লিখলেন ‘যেন আলেয়ারে বন্ধু ভাবিয়া হায়/ সহেলী গো যে কাছে গেলে দূরে সরে যায়।’ পছন্দ হল শচীন কর্তার । শুরু হল বাংলা সুরের জগতে নতুন গীতিকবির যাত্রা। এরপর একে একে মেঘ কালো আঁধার কালো’, ‘প্রেম একবারই এসেছিল নীরবে,’ ‘বাঁশি শুনে আর কাজ নাই’… গৌরীপ্রসন্নের কথায় ও শচীন দেববর্মণের সুরে সৃষ্টি হয়েছিল এমন অসংখ্য কালজয়ী গান।
সুরকার অভিন্ন হ্রদয় বন্ধু নচিকেতা ঘোষের মৃত্যুর পরে এক স্মরণসভায় তাঁর সঙ্গে প্রিয় বন্ধুর সম্পর্ক বিশ্লেষণ করতে গিয়ে গৌরীপ্রসন্ন বলেছিলেন, তাঁদের মধ্যে সম্পর্ক ইংরেজির ‘ইউ’ আর ‘কিউ’-এর মতো। হরিহর আত্মা হলেও এই বন্ধুর সঙ্গে গান তৈরি নিয়ে মাঝেমধ্যেই বেজায় তর্ক-ঝগড়া হত। কিন্তু সেই সব বিবাদ থেকে জন্ম নিয়েছিল এক-একটি অনবদ্য গান। নচিকেতা ঘোষের অধিকাংশ গানই তাঁর লেখা।কলেজ জীবন থেকে সম্পর্ক দু’জনের। প্রায় প্রত্যেক দিন সকালে শ্যামবাজারে ঘোষবাড়িতে চলে আসতেন তিনি। তার পরে চলত গান লেখা, সুর দেওয়ার কাজ। তারই ফাঁকে আড্ডা আর খাওয়াদাওয়া।
কিন্তু সব সময়ে সঙ্গীতসৃষ্টি চার দেওয়ালে মধ্যে হত, তা নয়। এমনই এক দিন গোলবাড়ির পরোটা আর কষা মাংস খেতে খেতে গৌরীপ্রসন্ন এক টুকরো কাগজে লিখলেন, ‘আমার গানের স্বরলিপি লেখা রবে’। নচিকেতা সুর করে ফেললেন। গাইলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। তৈরি হয়ে গেল আরও একটি কালজয়ী গান। সেই সময়ে ভারতের এমন এক জন বিখ্যাত সঙ্গীতশিল্পী নেই , যিনি গৌরীপ্রসন্নের লেখায় গান গাননি। শচীন দেববর্মণ, লতা মঙ্গেশকর, আশা ভোঁসলে, মান্না দে, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়, শ্যামল মিত্র, কিশোরকুমার, রাহুল দেববর্মণ, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, আরতি মুখোপাধ্যায়… নাম বলে শেষ করা যাবে না । এঁদের পাঁচটা সেরা গানের মধ্যে অন্তত একটা গান গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের লেখা।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়েছে। সেসময় একদিন আড্ডার মাঝে মুজিবরের বক্তৃতার রেকর্ডিং শুনছিলেন। তা শুনতে শুনতে সিগারেটের প্যাকেটের সাদা কাগজে গৌরীপ্রসন্ন লিখে ফেললেন — ‘শোনো, একটি মুজিবরের থেকে/ লক্ষ মুজিবরের কণ্ঠস্বরের ধ্বনি-প্রতিধ্বনি/ আকাশে-বাতাসে ওঠে রণি।’ সুর করলেন অংশুমান রায়, গাইলেনও তিনি। গানটা ইংরেজিতে অনুবাদও হয়। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে ১৯৭২-এর ডিসেম্বরে বঙ্গবন্ধুর আমন্ত্রণে রাষ্ট্রীয় অতিথি হিসেবে বাংলাদেশে গিয়েছিলেন গৌরীপ্রসন্ন। বাংলাদেশ রেডিয়োর জন্য লিখেছিলেন ‘মাগো ভাবনা কেন/ আমরা তোমার শান্তিপ্রিয় শান্ত ছেলে। হেমন্তের কণ্ঠে দুই বাংলাকে আন্দোলিত করেছিল সে গান।
হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ছিল খুবই মধুর। এক জায়গায় তিনি বলেছিলন হেমন্তবাবুর গাওয়া ‘আমার গানের স্বরলিপি লেখা রবে’ ওঁর জীবনে সর্বশ্রেষ্ঠ গান।’’ তিনি জোর দিয়ে বলতেন, উইদাউট গৌরীপ্রসন্ন হেমন্তবাবুর সুরকার ও গায়ক জীবন অসম্পূর্ণ। হেমন্তের কাছ থেকে ভালবাসাও পেয়েছেন তিনি। বিপদের সময়েও পাশে পেয়েছিলেন। এইচএমভি-র সঙ্গে মনোমালিন্য হওয়া কর্তৃপক্ষ গৌরীপ্রসন্নকে বয়কট করে। তখন হেমন্ত মুখোপাধ্যায় তাঁকে দিয়ে গান লিখিয়েছিলেন। একে একে তৈরি হয়েছিল, ‘ও নদীরে ‘ , ‘নীল আকাশের নীচে এই পৃথিবী’, ‘তারে বলে দিও’, ‘আজ দু’জনার দু’টি পথ’, ‘ওগো তুমি যে আমার’ , ‘মুছে যাওয়া দিনগুলি’, ‘এই রাত তোমার আমার’, ‘পথের ক্লান্তি ভুলে’, ‘এই পথ যদি না শেষ হয়’ – এর মতো অসংখ্য হিট গান। যা বাংলা ছবির ইতিহাসে নতুন অধ্যায় লিখলো।
ফ্লপ ছবিকেও শুধু মাত্র গানের জোরে সুপারহিট করে দিতে পারত গৌরী-হেমন্ত জুটি। ‘শেষ পর্যন্ত’ ছবিতে গল্প বলতে কিছুই ছিল না। প্রযোজকের পীড়াপীড়িতে এই সিনেমার জন্য লিখলেন ‘এই মেঘলা দিনে একলা ঘরে থাকে না তো মন’, ‘কেন দূরে থাকো শুধু আড়াল রাখো’, ‘এই বালুকাবেলায় আমি লিখেছিনু’… ছবি সুপারহিট। শুধু একবার নয় এমন ঘটনা অনেক বার ঘটেছে সেই সময়। অমল মুখোপাধ্যায় সঙ্গীত পরিচালনার সুযোগ পেয়ে গৌরীপ্রসন্নের কাছে এসে বললেন, এমন একটা গান লিখে দিন, যেন আমি চিরদিন থেকে যেতে পারি বাংলা গানে।’ উনি লিখে দিয়েছিলেন ‘এই সুন্দর স্বর্ণালী সন্ধ্যায় এ কী বন্ধনে জড়ালে গো বন্ধু’!
বাংলায় গান করার উৎসাহ দিয়েছিলেন মান্না দে-কে।
হেমন্তের পরে যে দু’জন শিল্পী তাঁর সবচেয়ে বেশি মন কেড়েছিল, তাঁরা হলেন মান্না দে এবং সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। ভি শান্তারামের ‘অমর ভূপালী’ ছবিতে প্লেব্যাক করবেন জগন্ময় মিত্র। তার জন্য বম্বেতে এসেছেন তিনি। কিন্তু রেকর্ডিংয়ের আগে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন। তখন শান্তারামকে মান্না দে-র নাম প্রস্তাব করেন গৌরীপ্রসন্ন। সেই থেকে বন্ধুত্ব। তাঁর জন্য প্রথম বাংলা গান লিখেছিলেন ‘তীর ভাঙা ঢেউ আর নীড় ভাঙা ঝড়’। এর পরে ‘হাজার টাকার ঝাড়বাতিটা’, ‘যদি কাগজে লেখো নাম’, ‘এমন বন্ধু আর কে আছে’, ‘আমি যামিনী তুমি শশী হে’, ‘কফি হাউসের সেই আড্ডাটা’… একটার পর একটা যুগান্তকারী গান। হিসেব করলে দেখা যায়, মান্না দেরও অধিকাংশ সুপারহিট গানের গীতিকার গৌরীপ্রসন্ন।
‘গানে মোর কোন ইন্দ্রধনু,’ ‘ঘুমঘুম চাঁদ,’ ‘জানি না ফুরাবে কবে এই পথ চাওয়া,’ ‘আকাশের অস্তরাগে’… এমন অসংখ্য সুপারহিট গানে খ্যাতির মুকুট পরিয়েছেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়কে। প্রকাশ্যে বলতেন, সুচিত্রা সেন-সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের জুটি কেউ টপকাতে পারবে না। সেরা অনেক গান তৈরি হয়েছে সুরের ওপরে কথা বসিয়ে। গৌরীপ্রসন্ন কখনও কখনও সুরের ওপরে কথা বসিয়েছেন। যে কাজটা তাঁর মতে ছিল কঠিন। ‘‘আমার সবচেয়ে সুপারহিট গানগুলোই তৈরি হয়েছে সুরের ওপরে কথা বসিয়ে। ‘গানে মোর কোন ইন্দ্রধনু’ আমার টার্নিং পয়েন্ট, সেটাও সুরের ওপরে কথা বসানো। এই গানে অনুপম ঘটক সুর দিয়েছিলেন।
আরও একটি ঘটনা উল্লেখ্য, শক্তি সামন্তের ‘আরাধনা’য় ‘মেরে সপনো কী রানি’ বা ‘গুনগুনা রহে হ্যায় ভঁবরে’ বাংলা করেছিলেন ‘মোর স্বপ্নের সাথী’ বা ‘গুঞ্জনে দোলে যে ভ্রমর।’ লিখেছিলেন অদ্ভুত ভাবে। এক দিকে সিনেমায় শিল্পীর লিপ মাথায় রাখতে হয়েছিল, অন্য দিকে হিন্দি গানের কথা। এমন শব্দ বাংলায় প্রয়োগ করতে হবে, যা হিন্দি শব্দের অর্থকে বোঝায়, আবার অভিনেতার ঠোঁট নাড়ানোর সঙ্গেও মেলে।
উচ্চারণের ব্যাপারেও ভীষণ খুঁতখুঁতে ছিলেন তিনি। গৌরীপ্রসন্ন -এর স্পেশ্যালিটি ছিল শব্দপ্রয়োগে। ওঁর মতো শব্দ নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করতে সচরাচর দেখা যায়নি। ‘অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি’র গানে রূপক ব্যবহার করেছিলেন ‘তোমার ওই ধূপছায়া রং শাড়ির পাড়ে’ বা ‘চাঁদ তুমি চির সুন্দর’ গানগুলিতে। ১৯৮৬ সালের মে মাসে, অসুস্থ শরীর নিয়ে শ্যামল মিত্রের জন্য গান লিখলেন গৌরীপ্রসন্ন— ‘এবারে যাওয়াই ভাল/ তুমি থাকো, আমি যাই’। এইচএমভির স্টুডিয়োয় গানটা রেকর্ডিংয়ের পরে একে অপরকে জড়িয়ে ধরেছিলেন।
শেষ বারের মতো হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার আগে লিখেছিলেন ‘যেতে দাও আমায় ডেকো না, কবে কি আমি বলেছি মনে রেখো না’। তাঁর মৃত্যুর পরে আশা ভোঁসলের কণ্ঠে রেকর্ড করা হয় গানটি। হাসপাতালে শুয়ে লিখেছিলেন শেষ গান, ‘এবার তাহলে আমি যাই, সুখে থাক ভালো থাক, মন থেকে এই চাই। তিনি যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বাঙালি তাঁকে যেতে দেয়নি। চিরকালের জন্য বাঙালি তাঁকে স্হান দিয়েছে মনের মনিকোঠায়। তিনি রয়েছেন, আগামী দিনেও সসম্মানে বিরাজ করবেন। বাংলা গান তাঁকে বাদ দিয়ে ভাবা সম্ভব নয়। সুরের ভুবনে গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের অবস্থান চিরকালীন।
Be the first to comment