ইন্দিরা গান্ধী একশো

Spread the love

দেবাশিস ভট্টাচার্য, সম্পাদক

আজ, রবিবার ১৯ নভেম্বর ২০১৭ ইন্দিরা গান্ধীর শততম জন্মদিন। ১৯৮৪ সালের ৩১ অক্টোবর বিচ্ছিন্নতাবাদীদের উস্কানিতে নিজের প্রহরীর রাইফেলের গুলিতে তিনি খুন হন। বিশ্ব রাজনীতির ইতিহাসে আর কোনও দেশের মহিলা নেত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সমান সম্মান পাননি। রাষ্ট্রনায়ক হিসাবে তাঁর স্থান ১৯৬৯ সাল থেকেই এক নম্বরে ছিল। সেইসময় আর দুজন মহিলা প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। ইজরায়েলে গোল্ডা মেয়ার, সিংহলে (এখন শ্রীলঙ্কা) সিরিমাভো বন্দরনায়েক। রাজনীতির বাস্তব অবস্থা ও মানুষের মনোভাব বোঝা এবং কোন সময়ে কী করতে হবে তা নির্ধারনে ইন্দিরা গান্ধীর ছিল অতুলনীয় যোগ্যতা ও ক্ষমতা।

১৯৬৭ সালের ভোটের ফল দেখে ইন্দিরা গান্ধী বোঝেন একই পথে চললে পরের ভোটে জেতা যাবে না। এইখানেই ইন্দিরা গান্ধীর কৃতিত্ব। ভোটের ফল দেখে মানুষের মনোভাব ও মেজাজ বুঝতেন, অন্যকিছু ভাবতে হবে বলে স্থির করেন। সেই চিন্তার প্রতিফলনই হল ১৯৬৯ সালের জুলাই মাসের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে কংগ্রেসের মধ্যে প্রগতিশীল বলে পরিচিত ভি ভি গিরিকে তিনি দলের প্রাচীনপন্থী নেতার বিরুদ্ধে দাঁড় করান। তুখোড় বুদ্ধিমতী ইন্দিরা গান্ধী তখন সেই চ্যালেঞ্জ নেন। তিনি সিপিআই, সিপিআইএম, এসএসপি, ডিএমকের সমর্থন চান। এই চারটি দলই ইন্দিরা গান্ধীকে সমর্থন করে। যার ফলে ভি ভি গিরি জিতে যান। সেটাই ছিল ভারতীয় রাজনীতির প্রথম টার্ণিং পয়েন্ট। এরপর ইন্দিরা গান্ধী ১৪টি বেসরকারী ব্যাঙ্ক জাতীয়করণ করেন। এর জেরে কংগ্রেস ভেঙে যায়। ইন্দিরা গান্ধীর নেতৃত্বে একটা কংগ্রেস, যার পোশাকি নাম ছিল কংগ্রেস (শাসক)। সাধারন লোকে বলত নব কংগ্রেস। এই অংশের সভাপতি হন জগজীবন রাম। আর প্রবীন বাঘা বাঘা নেতাদের কংগ্রেসের পোশাকি নাম হয় কংগ্রেস (সংগঠন)। লোকে বলত আদি কংগ্রেস। ব্যাঙ্ক জাতীয়করনের পর দেশের আর্থিক অবস্থা কিছুটা পাল্টায়। আগে ব্যাঙ্কে সাধারন লোক টাকা জমা রাখতেন আর কিছু শিল্পপতি ও বড় ব্যবসায়ী সেই টাকা ধার নিয়ে দারুন মুনাফা করতেন। জাতীয়করনের পর মাঝারী ও ছোট ব্যবসায়ীরাও সহজে ঋণ পেতে থাকেন। ৫ বছরের মাথায় অর্থাৎ ১৯৭৪ সালে দেখা যায় সারা দেশেই মাঝারী ও ছোট ব্যবসায়ীর সংখ্যা বেড়েছে। ১৯৭৩ সাল থেকেই কলকাতার রাস্তায় বেকার যুবকরা ব্যাঙ্কের ঋণ নিয়ে মিনিবাস রাস্তায় নামান। এরপর ইন্দিরা গান্ধী ১৯৭০ সালে রাজা মহারাজাদের ভাতা দেওয়া বন্ধ করে দেন। এরপর প্রধানমন্ত্রী বিমা কোম্পানিগুলি জাতীয়করন করেন। ব্যক্তি মালিকানার সম্পত্তি জাতীয়করন করায় বামপন্থীরা ইন্দিরা গান্ধীকে সমর্থণ করেন। ইন্দিরা গান্ধী তখন সচেতন দেশবাসীর কাছে প্রগতিশীল ও গরিব দরদি হিসাবে পরিচিত হন। রাজা মহারাজারা ভাতা বিলোপে রেগে গিয়ে ইন্দিরা গান্ধীর বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে মামলা করেন। সেই মামলায় ইন্দিরা গান্ধী হেরে যান। তিনি তখন লোকসভা ভেঙে দিয়ে নতুন করে মানুষের রায় চান। তিনি বলেছিলেন, আদালতে হেরেছি, গণ আদালতে যাব। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে লোকসভার সেই ভোট হয়। তখন লোকসভার সদস্য সংখ্যা ছিল ৫২২ (এখন ৫৪৩)। ইন্দিরা গান্ধীর নেতৃত্বে নব কংগ্রেস ‘গরিবী হঠাও’ স্লোগান দিয়ে ৩৫২টি আসন জেতেন। বিরোধীরা কুপোকাত হয়ে যায়।

১৯৬৬ সালের খাদ্য সংকট যাতে আর না হয় সেজন্য ১৯৬৮ সাল থেকেই পাঞ্জাব, হরিয়ানা, পশ্চিম উত্তরপ্রদেশে সবুজ বিপ্লব সংগঠিত হয়। উচ্চ ফলনশীল বীজ, সার, ট্রাক্টর ইত্যাদি দিয়ে চাষ করার ফলে গমের উৎপাদন বেড়ে যায়। যে জমিতে একটা ফসল হতো, সেখানেই সেচের ফলে তিনটি ফসল হয়। ১৯৫৬ সাল থেকে পিএল ৪৮০ ধারা মেনে আমেরিকা থেকে ভারতে গম আমদানি হত। ১৯৭২ সালের পর সেই আমদানি বন্ধ হয়ে যায়।

ভারত খাদ্য উৎপাদনে স্বনির্ভর হয়ে ওঠে। স্বাধীনতার পর থেকেই জওহরলাল নেহেরুর নেতৃত্বে ভারত সরকার জোট নিরপেক্ষ নীতি নেয়। কিন্ত ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারত সরকারের ষোলো আনা মদত সবাইকে অবাক করে দেয়। মুজিবর রহমান থেকে শুরু করে বাংলাদেশের বলতে গেলে সব নেতাই বলেছেন ইন্দিরা গান্ধীর মদত ছাড়া বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম হতো না।

জরুরী অবস্থা জারি করার জন্য ১৯৭৭ সালের মার্চে হওয়া লোকসভা ভোটে ইন্দিরা গান্ধীর নেতৃত্বে নব কংগ্রেস হেরে যায়। মোরারজি দেশাইয়ের নেতৃত্বে কেন্দ্রে জনতা পার্টির কোয়ালিশন সরকার বসে। ওই সরকারের শরিকদের মধ্যে ঝগড়া লেগেই থাকত। তুখোড় বুদ্ধিমতী ইন্দিরা গান্ধী সেটা নজর রাখতেন। ১৯৭৯ সালের মে মাস নাগাদ সেই ঝগড়া বেশ পেকে ওঠে। ইন্দিরা গান্ধী তাঁর দূত পাঠিয়ে সেই সরকারের সিনিয়র মন্ত্রী (প্রথমে স্বরাষ্ট্র পরে অর্থ) চরন সিংকে একটি প্রস্তাব পাঠান। প্রস্তাবে বলা হয় চরন সিং জনতা পার্টি ছেড়ে একটা নতুন পার্টি গড়ে প্রধানমন্ত্রী হতে চাইলে ইন্দিরা গান্ধীর দল তাঁকে সমর্থণ করবে। লোভী চরন সিং সেই কথা শোনেন। প্রধানমন্ত্রীও হন, কিন্তু মাত্র ১০০ দিনের জন্য। তারপর ইন্দিরা গান্ধী সেই সরকার থেকে সমর্থন তুলে নেন। ফলে ১৯৮০ সালের জানুয়ারী মাসে লোকসভা ভোট হয়। সেই ভোটে ইন্দিরা গান্ধীর স্লোগান হয়, মাঝপথে সরকার ভেঙে গিয়ে ভোট হলে গরীব দেশের আর্থিক চাপ বাড়ে। তাই সরকার গড়তে ইন্দিরার কংগ্রেসকে ভোট দিন। স্থায়ী সরকার গড়ার এই স্লোগান মানুষ গ্রহণ করেন।

কোন অবস্থায় কী স্লোগান দিতে হবে তা ঠিক করতে ইন্দিরা গান্ধীর সমতুল্য কোনও রাজনীতিবিদ আজ পর্যন্ত দেখা যায়নি। নেতা-নেত্রীরাও দোষে গুনে হয়। ইন্দিরা গান্ধীরও তেমন নেতিবাচক দিক ছিল। ইন্দিরা গান্ধীর আমলেই সবচেয়ে বেশীবার সংবিধানের ৩৫৬ ধারা প্রয়োগ করে ভিন্ন দলের রাজ্য সরকার ভাঙা হয়েছে। আর বলতে হয় জরুরী অবস্থা জারির কথা। ১৯৭৫ সালের ২৫শে জুন রাত বারোটায় সংবিধানের ৩৫২র (খ) ধারা প্রয়োগ করে জরুরী অবস্থা জারি করা হয়। জয়প্রকাশ নারায়ন সহ সব বিরোধী নেতাদের বিনা বিচারে আটক করা হয়, তখন বেসরকারি টিভি চ্যানেল ছিলনা। সরকার জরুরী অবস্থা জারি করেই কাগজে সেন্সরশিপ চালু করে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতার লাইন (‘চিত্ত যেথা ভয় শূন্য উচ্চ যেথা শির’) টি দেখেই আমলারা কেটে দেন। হাজার হাজার লোককে বিনা বিচারে আটক করা হয়। সংবিধানের ১৯(ক) ধারায় দেওয়া মৌলিক অধিকারকে লিখিত ভাবেই সরকার কেড়ে নেয়। স্বাধীনতার পর বিগত ৭০ বছরের ইতিহাসে জরুরী অবস্থার ২১ মাস কালো অধ্যায় হিসাবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে।

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*