তপন মল্লিক চৌধুরী
বিগত কয়েক বছরে লোকালয়ে হাতি বা অন্যান্য জন্তু জানোয়ার ঢুকে পড়া বা হানা-র ঘটনা ঘটেছে বহুবার। সব ক্ষেত্রেই যে প্রানহানি ঘটেছে তেমনটা নয়, কিন্তু তাণ্ডব বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ঘরবাড়ি ভাঙ্গা, খেতখামার নষ্ট হওয়ার মত মারাত্মক আকার ধা্রন করে। প্রবল চাপে পড়ে প্রশাসন বা বনদফতর হাতিসহ অন্যান্য বন্যপ্রাণীর হানা রুখতে একাধিক প্রকল্পের কথাও ঘোষণা করে, তবে সেসব উদ্যোগ বা প্রকল্প যে কেবলমাত্র মুখের কথা বই অন্য কিছু নয় তা জঙ্গল লাগোয়া বা বনবস্তির মানুষ মাত্র এখন জানে। কারণ হাতি কিম্বা বন্য জন্তু হানার ঘটনায় যখনই বনদফতর তীব্র সমালোচনার সম্মুখীন হয় তখনই অবস্থা সামাল দিতে তারা সাদা মিথ্যার প্রতিশ্রুতি দিয়ে থাকে। কিন্তু মিথ্যা প্রতিশ্রুতির থেকেও বড় প্রশ্ন হল জঙ্গল কিম্বা সংলগ্ন এলাকায় হাতি বা বন্যজন্তুর হানা রোখা অথবা রুখতে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা কি স্বয়ং বনদফতর বলতে পারে? পাশাপাশি আরেকটি প্রশ্নও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে যে, হাতি লোকালয়ে ঢুকে পড়ছে না কি মানুষই হানা দিয়েছে হাতির এলেকায় ?
ঘটনা হল যেদিন থেকে নগর সম্প্রসারণের জন্য জঙ্গল সাফাই অভিযান শুরু হয়েছে, বলা যায় সেদিন থেকেই লোকালয়ে হাতি এবং বন্যজন্তু ঢুকে পড়ার ঘটনা একের পর এক ঘটে চলেছে। তারপর যত দিন এগিয়েছে , সভ্য নাগরিকদের ঘরবাড়ি, জমিজিরেতের সীমানা বাড়তে বাড়তে জঙ্গল এলাকায় ঢুকে পড়ে। আধুনিক সমাজসভ্যতা জঙ্গল দখল করে ওই বসতি নির্মাণ করার নামকরণ করেছে বনবস্তি। শুধু যে বনবস্তি তা তো নয়, বসতির পাশাপাশি সভ্য নাগরিকদের প্রমোদভ্রমণেরও ব্যবস্থা চালু রয়েছে, তারজন্য বন্যপ্রানীদের কোর এলাকা দখল করে পাকা নির্মাণ উঠেছে, যার নাম দেওয়া হয়েছে রিসর্ট। সভ্য নাগরিক জঙ্গল আর বন্যজন্তুজানয়ার দেখতে খুবই পছন্দ করে, শহর থেকে কাতারে কাতারে মানুষ প্রায়শই ছুটছে সেই অভিমুখে, নাগরিকদের জঙ্গলপ্রীতি আর বন্যপশু দেখার ইচ্ছে মেটাতে রাশি রাশি গাড়ি মানুষ বোঝাই করে ছুটছে নিবিড় অরণ্যের গভীরে, যার নামকরণ হয়েছে সাফারি। ফলত অরণ্যে সভ্য নাগরিকদের ভিড় যেমন বেড়েই চলেছে তেমনই ধোঁয়া ধুলো উড়িয়ে রাশি রাশি সাফারি ছুটছে প্রচন্ড শব্দে আর বন্যজন্তুরা প্রাণ বাঁচাতে ক্রমশই পিছু হটছে। কিন্তু আমরা ক্লান্তিহীন ভাবে বলেই চলেছি–লোকালয়ে হাতি ঢুকে পড়েছে, মানুষের বসতিতে হাতির হানা। কেবল আমরা নই বনদফতর বা প্রশাসনও জানাচ্ছে হাতির হানা রুখতে আবিলম্বে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। এমনকিতারা এক থেকে একাধিক প্রকল্পের কথাও ঘোষণা করে দেয়। ওইসব প্রকল্প বাস্তবায়িত হক না হক সে প্রশ্ন ভিন্ন কিন্তু এখানে জরুরি প্রশ্ন হল খোদ বন দফতর কোন যুক্তি-বুদ্ধিতে হাতিদের কোণঠাসা করে দেওয়ার কথা এভাবে দিনের পর দিন ঘোষণা করতে পারে ?
অরণ্য ধ্বংস করে বসতি গড়ে তোলার সময় থেকেই বিঘ্ন ঘটেছে এলিফ্যান্ট করিডর বা হাতি চলার পথ-এ। জঙ্গল বা সংলগ্ন এলাকার মধ্যে দিয়ে হাতি ওই পথ তৈরি করে মূলত খাদ্যানুসন্ধান বা জীবন নির্বাহের জন্য। কিন্তু নিজ বাসভূমেই আজ উদবাস্তু হয়ে পড়েছে জঙ্গলের আদি বাসিন্দা। জঙ্গলে হাতির খাদ্য নেই। একটি পূর্ণবয়স্ক হাতির পেট ভরতি হতে প্রতিদিন দরকার পড়ে প্রায় দেড়শ কেজি পরিমাণ খাদ্য। তার খাদ্য-তালিকায় রয়েছে বুনো বাঁশের মূল, কচি বেত, কলা গাছের ভিতরের সাদা অংশ, শাল গাছের গোঁড়ায় গজানো গুল্ম ইত্যাদি। হাতিও জানে একটি জঙ্গল দিনের পর দিন ওই পরিমাণ খাদ্য জোগান দিতে পারে না। সেই কারণেই হাতি এক জঙ্গল থেকে আরেক জঙ্গল ফের সেখান থেকে আরেক জঙ্গলে যায় এবং একদিন ফেলে যাওয়া জঙ্গলে ফিরে আসে ওই করি্ডর বা পথ ধরে আর ততদিনে ছেড়ে যাওয়া জঙ্গল ফের খাদ্যসম্ভারে সেজে ওঠে। এই পরিক্রমণ যেমন নির্দিষ্ট পথ ধরে তেমন নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে। এই কারনেই হাতি দল বেঁধে বাস করে। দুনিয়ারর সব জঙ্গলেই হাতির জীবননির্বাহ চলে এই নিয়মে ।
কিন্তু হাতি তার চেনাজানা পথ এখন প্রায়ই গুলিয়ে ফেলছে। কারণ তার নির্দিষ্ট চলার পথে কখনো গজিয়ে উঠছে বসতি, কখনো রিসর্ট…হাতি ওই বাধা টপকে হঠাৎ করে আলাদা পথও তৈরি করে ফেলতে পারছে না। কারণ বনভূমির মধ্যে, নদীর চরে পিলপিল করে গজিয়ে উঠছে মানুষের বসতি এবং নানাধরনের নির্মাণ। জনপদ থেকে শুরু করে ওইগুলি সবই সম্পূর্ণভাবে বেআইনি এবং নিষিদ্ধ। অথচ আমরা বলেই চলেছি লোকালয়ে হাতির হানা,বনদফতরও সেই একই সুর বাজিয়ে চলেছে বহুকাল ধরে। কারণ প্রাথমিক অবস্থা থেকেই প্রশাসন ওইসব বেআইনি ও নিষিদ্ধ বসতি এবং নির্মাণ জেনেবুঝে এড়িয়ে চলেছিল। অথচ হাতি তার অভ্যস্ত পথ ধরে চলাফেরা করলেই আমরা এবং প্রশাসন বলছি অনুপ্রবেশ, হাতির হানা…সেই আক্রমণ রুখতে তৎপর প্রশাসন এমনকী সরকারও। তাহলে কী বুঝতে হবে যে নিজের বাসভুমেই আজ আদি বাসিন্দারা উদবাস্তু, জঙ্গলে তাদের দিন ফুরিয়ে এল বলে ।
Be the first to comment