তপন মল্লিক চৌধুরী : মাত্র এক বছর যখন বয়স তখন তাঁর বাবা মারা গেলেন। মূক-বধির মায়ের হাত ধরে এলেন মামারবাড়ি। আশ্রয় পেলেন ঠিকই কিন্তু তাঁর মাকে রোজগারে নামতে হলো। ধনী ফরাসি পরিবারে পরিচালিকার কাজ—তাতেই চলে সংসার। সংসারে রয়েছেন দিদিমা, ভীষণ কড়া ধাঁচের মানুষ। নিয়ম করে তিনি নাতিকে পেটান দু-বেলা। ওদিকে নাতির খুব আগ্রহ খেলাধুলায়, বিশেষত ফুটবলে। দিদিমা খেয়াল রাখেন নাতি জামাকাপড় ময়লা করল কি না, জুতো জোড়া পরিপাটি আছে কিনা। ময়লা ছেঁড়া-ফাটা দেখলেই বেদম মার। তাতে কি আর নাতির ফুটবলে আগ্রহ দমে! ভেবেচিন্তে ফুটবল-পাগল বালক ফুটবল মাঠের এমন জায়গা বেছে নেয় যেখানে সারা মাঠ দাপিয়ে বেড়াবার সুযোগ নেই অথচ খেলায় অংশ ন্যেয়া যায় জুতো জোড়া বাঁচিয়েই। সেই যথাযথ জায়গা হলো তিনকাঠির মাঝখানে অর্থাৎ গোলকিপিং। দুটো পোস্ট, বার আর জাল—সামনে দাঁড়িয়ে গোলরক্ষা, প্রতিপক্ষ আর স্বপক্ষ বল নিয়ে লড়াই করছে মাঝমাঠে আর গোলরক্ষক একা দাঁড়িয়ে আছে পোস্ট-এর সামনে। যদিও তীক্ষ্ম দৃষ্টি নজর রাখতে হচ্ছে বলের দিকে তবুও সে দল থেকে খানিকটা দূরে একটু নির্জনে। দৌড়-ঝাপ-দাপাদাপির সুযোগ নেই বলেই জুতো জোড়ার ছেড়া ফাটার সম্ভাবনাও কম, দিদিমার বেদম মারের হাত থেকেও রেহাই। ফুটবল খেলার আসল কথাই হলো গোল। নিজের দল গোল করলে গোলকিপারের কোনও কৃতিত্ব থাকে না কিন্তু তাকেই বাঁচাতে হয় প্রতিপক্ষের গোল—এটাই তার দায়িত্ব। কিন্তু গোল খেলে দোষ তারই। একা এবং কয়েকজনের খেলা ফুটবলকেই ভালোবেস ফেলেন আলব্যের কামু।
আউটসাইডার, প্লেগ, ফল-এর মতো উপন্যাস, ক্যালিওলা-র মতো নাটক, মিথ অব সিসিফাস, রেবেল-এর মতো দার্শনিক ভাবনার রচনা এবং মাত্র বিয়াল্লিশ বছর বয়সে সাহিত্যের নোবেল পকেটে পুরে ফেলা ঔপন্যাসিক, নাট্যকার। দার্শনিক আলব্যের কামু ছাত্রাবস্থায় আলজিরিয়ার রেসিং বিশ্ববিদ্যালয়ের জুনিয়র দলে সুনামের সঙ্গে ফুটবল খেলেছিলেন। কিন্তু সুনাম থেকে আর খ্যাত হওয়া হয়ে ওঠেনি—১৮ বছর বয়সে বুকে বাসা বাঁধল টিবি। দীর্ঘ চিকিৎসায় প্রাণের বাঁচলেন ঠিকই, ফুসফুস দুটো ক্ষতিগ্রস্ত হলো। ছেড়ে দিতে হল ভালোবাসার ফুটবল। তুলে রাখতে হলো ফুলহাতা জার্সি, গ্লাভস আর বুট। দল থেকে খানিকটা দূরে নির্জনে একা দাঁড়িয়ে থাকা গোলরক্ষক কামু তিন কাঠির সামনে থেকে সরে গেলেন। দ্য লাস্ট ম্যান অব ডিফেন্স অ্যান্ড দ্য ফার্স্ট ম্যান অব অ্যাটাক—গোলকিপার আলব্যের কামু পরবর্তীতে একটি ক্রীড়া পত্রিকায় তাঁর ফুটবল দিনের স্মৃতিচারণে লেখেন, মানুষের নীতি-নৈতিকতা ও কর্তব্যবোধ সম্পর্কে তিনি নিশ্চিতভাবে যা জানেন, বোঝেন তার জন্য তিনি ফুটবলের কাছে কৃতজ্ঞ। বলা যেতে পারে জুতোজোড়ার ছেড়া ফাটা বাঁচিয়ে দিদিমার বেধড়ক মার থেকে রেহাই পেতে কামু ফুটবলের যে পজিশন বেছে নিয়েছিলেন তাতে মনে হয় শৈশবেই যেন তিনি চিনে বুঝে ফেলেছিলেন নিঃসঙ্গ সিসিফাসকে।
ঈশ্বর সিসিফাসকে অভিশাপ দিয়েছিলেন পাহাড়ের ওপরে পাথর গড়িয়ে তোলার কাজে, প্রতিবারই পাহাড়ের ওপর থেকে সেই পাথর তার ভারে নীচে গড়িয়ে পড়ে আর সিসিফাস সেই পাথরটিকে আবার পাহাড়ের ওপরে গড়িতে তোলে…। মানুষ এরকমই অভিশপ্ত, যা পাওয়া অসম্ভব, তাকেই পাওয়ার জন্য মানুষ যাবতীয় উদ্যোগ নেয়। মানুষের সবথেকে জরুরি অবলম্বন সমস্ত ধরনের স্বাধীনতা, কিন্তু মানুষ যখন সম্পূর্ণ স্বাধীন তখন সে একা, পৃথিবী পরিত্যক্ত হয়ে নিভৃতে তার বাস। কামু সিসিফাসের অভিশপ্ত আখ্যানকে ঘুরিয়ে দেন। অন্য অর্থ তৈরি করেন—সিসিফাস তার ভবিতব্য নিশ্চিতভাবেই জানে। পণ্ডশ্রম চেতনাও তার ষোলোআনা। কিন্তু সে আবার নিচে নেমে পাথরটা ঠেলে পাহাড়ের মাথায় তোলে। কিন্তু কেন? কারণ তার চৈতন্য। সিসিফাস তার সচেতনতা দিয়ে নিয়তির বিরোধিতা করে, ঈশ্বরকে চ্যলেঞ্জ জানায়, মৃত্যুর সঙ্গেও পাঞ্জা কষে, শৃঙ্খলের জায়গায় দেয় স্বাধীনতা। শেষ পর্যন্ত সিসিফাস হয়ে ওঠে হিরো। অ্যাবসার্ড হিরো। অ্যাবসার্ড মানে? আলাদা করে মানে এর কোনও মানে নেই কারণ মানে করতে হয় জীবনে।
জীবনে নতুন মনে করতেই আলব্যের কামু ভূমধ্যসাগর পেরিয়ে চলে এসেছিলেন ফরাসি দেশে। বেঁচে থাকার ইচ্ছে নিয়েই সঙ্গে এনেছিলেন তাঁর উপন্যাসের পাণ্ডুলিপি। সাংবাদিকতা আরম্ভ করেছিলেন, প্যারিসে জড়িয়ে পড়েছিলেন নাৎসি-বিরোধী আন্দোলনে। ‘কমব্যাট’ নামে এক আন্ডারগ্রাউন্ড পত্রিকার সম্পাদকও ছিলেন। একটা সময় কমিউনিজম-এ বিশ্বাস করতেন। ফরাসি কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হয়েছিলেন। আবার ‘দ্য বেবেল’-এর স্তালিনবাদের ভয়াবহতা চিহ্নিত করাতে বন্ধু জাঁ পল সাএ কামুকে ত্যাগ করেন। অন্যান্য বন্ধুদের থেকেও দুর্ব্যবহার পেয়েছিলেন। অথচ আশ্চর্য হতে হয় ব্রিটেনের ‘ফিলোজফি ফুটবল’ সংস্থা প্রতি বছর পাঁচ হাজার গোলকিপার জার্সি বিক্রি করে যার কাঁধে লেখা থাকে আলব্যের কামুর নাম। লেভ ইয়াসিন, গর্ডন ব্যাংকস বা অলিভার কান-এর মতো কিংবদন্তি গোলকিপাররা নন। আলজিরিয়ার সামান্য এক গোলকিপার-এর কথাও ওই জার্সিগুলিতে লেখা থাকে, ‘মানুষের নীতি নৈতিকতা ও কর্তব্যবোধ সম্পর্কে নিশ্চিতভাবে আমি যা জানি তার জন্য আমি ফুটবলের কাছে ঋণী।’
Be the first to comment