তপন মল্লিক চৌধুরী,
এই তো দু’দিন আগে কলকাতা প্রেস ক্লাবে সিপিআই (এমএল) নেত্রী ও সমাজকর্মী কবিতা কৃষ্ণান, অর্থনীতিবিদ জঁ দ্রেজ এবং সমাজকর্মী মাইমুনা মোল্লা ও বিমল ভাই ৩৭০ ধারা বিলোপ করার পর কাশ্মীরের পরিস্থিতি জানিয়ে গেলেন। কাশ্মীরে ইন্টারনেট, মোবাইল পরিষেবা বন্ধ। রাতে বাড়িতে হানা দিয়ে কিশোরদের তুলে নিয়ে যাচ্ছে নিরাপত্তা বাহিনী। গোটা রাজ্যের বিরোধী নেতারা বন্দী। সরকারের অনেক কর্মকর্তা বলছেন কিছু দিন মোবাইল-ইন্টারনেট না চললে কী হয়েছে? কিন্তু মোবাইল-ইন্টারনেট না থাকায় কাশ্মীরের অনেক গরিব মানুষের চিকিৎসা আটকে যাচ্ছে। কারণ, যে সরকারি প্রকল্পের অধীনে তাদের বিনা খরচে চিকিৎসা হতে পারে ইন্টারনেটের অভাবে চিকিৎসকরা সেই প্রকল্পের সাইটে লগ ইন করতে পারছেন না। কাশ্মীরীদের কাছ থেকে শান্তিপূর্ণ উপায়ে প্রতিবাদের অধিকার কেড়ে নেয়া হয়েছে। কাশ্মীর সামরিক বাহিনীর দখলে রয়েছে। প্রত্যেক সড়ক, প্রত্যেক বাড়ির সামনে, এমনকি প্রত্যেকটি মহল্লার মুখে আধা-সামরিক বাহিনী মোতায়েন রয়েছে। অবস্থাটা অত্যন্ত উদ্বেগজনক! কারও কোনো কথা বলার সুযোগ নেই, শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের সুযোগও নেই। ওইদিন কলকাতা প্রেস ক্লাবে তাদের তৈরি ভিডিও রিপোর্ট ‘কাশ্মীর কেজড’ দেখানো হয়। তাতেও উপত্যকার বিভিন্ন অংশের ছবি ধরা পড়েছে।
কেন্দ্র সংবিধানের ৩৭০ ধারা বিলোপ করার পর থেকে এখন পর্যন্ত কয়েক হাজার যুবককে আটক করা হয়েছে বলে অভিযোগ। রাজনীতিবিদ শেহলা রশিদ দিল্লিতে একের পর এক টুইট করে বলেছেন, সশস্ত্র বাহিনীর লোকেরা রাতে বাড়িতে বাড়িতে হানা দিয়ে যুবকদের তুলে নিয়ে যাচ্ছে। বাড়িতে ঢুকে ভাঙচুর করছে, খাবার ফেলে দিচ্ছে, চালের বস্তায় তেল ঢেলে দিচ্ছে এবং মেয়েদের ওপর নির্যাতন চালাচ্ছে। তিনি লিখেছেন, সোপিয়ানের একটি আর্মি ক্যাম্পে চারজন যুবককে ধরে নিয়ে গিয়ে জেরা ও নির্যাতন করার সময় তাদের সামনে মাইক্রোফোন ধরে রাখা হয়েছিল – যাতে তাদের চিৎকারের আওয়াজ শুনে গোটা এলাকা ভয় পায়। যদিও শেলা রশিদের দাবিকে সামরিক বাহিনী ফেক নিউজ বলে উড়িয়ে দিয়েছে। পাশাপাশি এইসব অভিযোগকে মিথ্যা রটনা বলে দাবি করে সুপ্রিম কোর্টে তার বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলার দাবি করেছেন আইনজীবী অলক শ্রীবাস্তব।
এদিকে জম্মু ও কাশ্মীরে আবার স্কুল খোলার কথা থাকলেও বেশির ভাগ স্কুলই খোলেনি, বা খুললেও বাচ্চারা যায় নি। এতদিন পরে সরকার ফের জম্মু ও কাশ্মীরে সব স্কুল খোলার উদ্যোগ নিলেও সে চেষ্টা কার্যত ভেস্তে গেছে। প্রথমে ঠিক হয়েছিল, ক্লাস এইট পর্যন্ত বাচ্চারা স্কুলে আসবে, পরে সেটাকে শুধু ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত করার সিদ্ধান্ত হয়। যাই হোক কারফিউ-র মধ্যে বাবা-মারা শেষ পর্যন্ত বাচ্চাদের স্কুলে পাঠানোর ঝুঁকি আর নেননি। ফলে প্রশাসন যা-ই দাবি করুক কাশ্মীরের পরিস্থিতি এখনও স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক দূরে। কিন্তু তারই মধ্যে যুবকদের আটক করা বা তুলে নেওয়া চলছে আর তাতে আরও আতঙ্ক ও উত্তেজনা ছড়াচ্ছে।
কাশ্মীরে নিরাপত্তা বাহিনীর ভয়াবহ নির্যাতনের ছবি উঠে এসেছে আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থার প্রতিবেদনে। লাঠি এবং তার দিয়ে পেটানোর পাশাপাশি কাশ্মিরীরা বৈদ্যুতিক শক দেওয়ার অভিযোগ তুলেছে। কয়েকটি গ্রামের মানুষের সঙ্গে কথা বলে ওই সংবাদ সংস্থার প্রতিবেদক জানতে পারেন, গ্রামবাসিদের লাঠি ও তার দিয়ে পিটিয়ে বৈদ্যুতিক শক দেওয়া হত। গ্রামবাসিরা জখম হওয়া শরীর ওই প্রতিবেদককে দেখিয়েছে। কাশ্মিরী রাজনৈতিক নেতা-কর্মীসহ কমপক্ষে ৩,০০০ মানুষ গ্রেপ্তার। কারাগারের জায়গা না হওয়ায় বন্দিদের অন্য রাজ্যের কারাগারগুলিতে পাঠানো হয়েছে। একটি আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থার প্রতিবেদক বেশ কয়েক দিনে প্রায় ছ’টি জেলা ঘুরে দেখেছেন যে প্রায় সবক’টি গ্রামে রাতের বেলায় নিরাপত্তা বাহিনীর অভিযান যেমন চলে তেমনি ভয়াবহ নির্যাতনও চলে গ্রামবাসিদের ওপর।
নিরাপত্তা বাহিনীর লোক অনেক সময় ঘুম থেকেও তুলে নিয়ে যায়। গ্রামবাসিদের কথা অনুযায়ী নিরাপত্তা বাহিনীর লোক শুধু তাদের পেটাতে থাকে। কোনও কথার উত্তর দেয় না। তারা আমার শরীরের প্রতি অঙ্গে আঘাত করার পর বৈদ্যুতিক শক দেয়। অজ্ঞান হয়ে গেলে বৈদ্যুতিক শক দিয়ে জ্ঞান ফেরানোর চেষ্টা করে। মারধরের সময় চিৎকার করলে মুখে মাটি গুঁজে দেয়। অনেককে সেনা ক্যাম্পে নিয়েও জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে এবং নির্যাতন করা হয়েছে। নির্যাতন করে হাত পা ভেঙে দেওয়াও হয়েছে। কাউকে হাত-পা বেঁধে উল্টো করে ঝুলিয়েও নির্মমভাবে পেটানো হয়েছে। উপত্যকাজুড়ে এখন পর্যন্ত ৪ হাজার ১০০ জনকে গ্রেফতার করেছে নিরাপত্তা বাহিনী। ৬০৮ জনের বিরুদ্ধে বিতর্কিত জননিরাপত্তা আইনে মামলা দেওয়া হয়েছে। তাদের প্রায় সবাইকেই উপত্যকার বাইরে উত্তর প্রদেশ ও মধ্যপ্রদেশের নানা জেলে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। বাড়ি বাড়ি তল্লাশি করে যুবক যুবতীদের তুলে নিয়ে যাওয়া চলছে। গণধর্ষণ, নির্যাতন, লুটপাট চলছে একই সঙ্গে। কিন্তু কোনও খবর করতে দেওয়া হচ্ছে না। কিছু কিছু খবর ফাঁক দিয়ে গেলে আসছে বিভিন্ন স্যোশাল মিডিয়ায়। কাশ্মীরীদের প্রতিরোধের খবর চেপে যাচ্ছে ভারতের মেইনস্ট্রিম মিডিয়াগুলো।
কাশ্মীরের বহু জায়গায় বিক্ষোভ আন্দোলন চলছে, বিক্ষোভে ফুসছে কাশ্মিরের জনতা। কিন্তু সরকার বলে চলেছে পরিস্থিতি অনেকটাই স্বাভাবিক, শান্তি ফিরে আসছে কাশ্মিরে। যেসব রাস্তা স্থানীয় মানুষ আর পর্যটকের ভিড়ে গমগম করত সে জায়গা এখন মরুভূমি। মোড়ে মোড়ে কাঁটাতারের বেড়া, নিরাপত্তা বাহিনীর তল্লাশি চৌকি আর সেনা-পুলিশের অবিরাম টহল। স্থবিরতা নেমে এসেছে চারপাশে। ধ্বংসের মুখে সমৃদ্ধ পর্যটন শিল্প। বিপর্যস্ত কাশ্মিরের অর্থনীতি।
Be the first to comment