তপন মল্লিক চৌধুরী,
বই পড়ি আর না পড়ি আমি কিন্তু বই কিনি, বইমেলায় গিয়ে বই কিনি আর না কিনি আমি কিন্তু হুজুগ পছন্দ করি। বই মেলার নানা ঘটনা আমি লক্ষ্য করি। আমার মন ভরে যায় যা দেখে শুনে পড়ুয়ারা রেগে যান, আমি রেগে যাই বই দেখে কারন আমি বৈরাগী। তবে বই মেলার নানা ঘটনা আমাকে বেশ আনন্দ দেয়।
আমার মনে হয় বইমেলা বা বই নিয়ে আর কি বলার আছে? বাংলা প্রকাশনার হাল- বেহাল বলা যাবে না। তাহলে কি বাংলা প্রকাশনায় প্রায়শই নতুন নতুন দিক উন্মচিত হচ্ছে? কিছু কিছু ধারণা আগে ছিল, তার মধ্যে অনেক কিছুই এখনও আছে, অনেক কিছু আর নেই। বাঙালি প্রকাশকরা শিক্ষিত হয়ে গিয়েছেন। সবাই? বানান ভুল অনেক কমেছে। কমেনি কি? সম্পাদনা ব্যাপারটাই ছিল না। এখন পুরোদমে থাকে? বইয়ের ছাপাই বাঁধাই থেকে শুরু করে সমস্ত কিছুতেই একটা ঝকঝকে তকতকে ভাব এসে গেছে। তার মানেই বাংলা বই এখন জাতে উঠেছে। তাই তো। নাকি ভুল বললাম? আমি সেকারণেই এসব ব্যাপারে মাথা ঘামাতে চাই না। আমি মেলায় ঘুরি ফিরি আর নানা দৃশ্যে মশগুল থাকি।
গত বছরের মতো এবারও সেই দৃশ্য দেখলাম সব মেলার সেরা বাঙালির বইমেলায়। আমাদের একান্ত প্রিয় বইমেলা, আমাদের হুজুগের, আদিখ্যেতার, ধ্যাষ্টামোর বইমেলায় এমন অনেক ঘটনাই আছে যা এড়ানো যায় না। একটা দৃশ্যের কথা বলি। স্টলের সামনে প্রচণ্ড ভিড়। লোকজনের হুড়োহুড়ি। খাবার নিয়ে, খাবারের ব্যাগ নিয়ে, কাগজের প্লেট নিয়ে…সে এক দেখার মতো দৃশ্য। আসল ঘটনাটা হল বৌদি মাসি পিসি কাকিমারা বাড়ি থেকে খাবার বানিয়ে নিয়ে এসেছেন, কাছাকাছি যারা তারা চা কফিও এনেছেন, ফলত হুল্লোড়। প্রবীণেরাও কম যান না। এর মধ্যে এক পিসি জানালেন কাল তিনি চিলি চিকেন আর আলু পরোটা নিয়ে আসবেন। ওই পিসির কথা শেষ হতেই এক বৌদি বললেন তিনি শনিবার বিরিয়ানি নিয়ে আসবেন। এবার প্রকাশক জল খেয়ে কফিতে চুমুক মেরে জানাতে চাইলো তাহলে অচিন্ত্য ব্যারাকপুরের দাদা বৌদির দোকানের বিরিয়ানি কবে আনবে? ঘটনার এই পর্যন্ত হুল্লোড় ঠিকই কিন্তু সেটা নেহাতই মেলা বা উৎসবের একান্ত মেজাজ। মেলার আবেগ বা আমেজের কারণে ঘটনাকে হুল্লোড় বা হুজুগ মনে হয়। আসলে ওই মাসিপিসিকাকিবউদিরা প্রত্যেকেই সুলেখক। প্রত্যেকেরই গল্প-কবিতা-উপন্যাস-ভ্রমন-ইত্যাদি প্রভৃতির একাধিক বই রয়েছে। হই হুল্লোড় ওই প্রকাশকের স্টলেই।
নিয়ম করে ওইসব লেখকরা ফেসবুকে তাদের গল্প-উপন্যাস-কবিতা লেখেন। লেখকদের ভক্ত সংখ্যাও যথেষ্ট। সেটা লাইক দেখে বোঝা যায়। কম পক্ষে দেড় দুশো। বছরের শেষে মানে বই মেলার মাস তিন চার আগেই লেখকরা প্রকাশকের সঙ্গে বসে টাকা পয়সার হেসান নিকেশ করে নেন। ফেসবুক মারফত প্রচার-এর কৌশলও ঠিকঠাক করে ফেলেন। প্রকাশক তার লাভের টাকা রেখে বইটি প্রকাশ করেন। কোনও বই শ’দুই, কোনওটা বড়জোর শ’চারেক। দু’চারজন লেখক বইমেলার দিনগুলিতে দুপুর থেকে সন্ধে ওই প্রকাশকের স্টলে কিংবা তার আশপাশেই ঘোরাঘুরি করেন। লেখকরা তাদের বন্ধু, আত্মীয় ধরে ধরে আনেন আর ওই স্টল থেকে বই কেনান, বইয়ে সই করে দেন।
দু’একজন লেখিকা আছেন যারা রোজ সন্ধ্যেবেলা ওই স্টলে আসেন, বাড়ি থেকে নানা রান্নাবান্না, চা কিংবা কফি নিয়ে আসেন। সবাই মিলে হইহই করে সেসব খাওয়া হয়। তাতেও তারা শান্তি পান না। জিঙ্গাসা করেন কাল কি নিয়ে আসবেন। তবে ওই লেখিকারা প্রায় প্রত্যেকদিনই নিজের বই কুড়ি পঁচিশটা কেনেন আর সই করে নানা মানুষদের উপহার দেন। এমন বেশ কয়েকজন লেখক আছেন যারা তার মামা শ্বশুরের কিংবা পিসি শ্বশুরের বাড়ির লোকজনকেও ওই স্টলে জমা করেন। তারাও লেখক জামাইয়ের বই কেনেন। সব মিলিয়ে একটা হইহই রইরই ব্যাপার ওই স্টলে লেগেই থাকে।
এখানে থামা যাবে না। প্রকাশক যাদের বই ছেপেছেন তাদের থেকে নানা বই উপহার চেয়ে নেন। লেখকরাও জানেন প্রকাশকের জন্য বইমেলা থেকে বই কিনতে হবে। সেকারণে তারা বই ছাপা বাবদ সেই টাকার অঙ্কটাও বাজেটে ধরে রাখেন। তার মানে প্রকাশক বই ছেপে যেমন রোজগার করছেন তেমনি বই উপহার নিয়েও তার একধরনের রোজগার হচ্ছে। তারমানে কি বই বেঁচে তেমন কিছু হচ্ছে না? আমার সেসব নিয়ে মাথা ব্যাথা নেই। প্রকাশককে আমি একবার জিঙ্গাসা করেছিলাম অবশ্য, প্রকাশক স্পষ্ট করে বলেছিল, তিনি (পয়সা নিয়ে লাভ রেখেই) ওদের বই না ছাপলে আর কেউই নাকি ছাপতো না। কেন না; প্রকাশকের মতানুসারে, বাসি খবর কাগজ দিয়ে ঠোঙা তৈরি হয় কিন্তু ওই সব বই কিংবা ছাপা কাগজ দিয়ে নাকি সেটাও হবে না। সেই কারনে প্রকাশক একই লেখকের বই দুবারের বেশি তিনবার ছাপেন না। লেখকের সঙ্গে সম্পর্ক যেন তেন খারাপ করেন। এক এক করে তিনি উদাহরনও দিলেন। এবারও তেমনটা ঘটিয়েছেন।
এরকম ঘটনা আমাদের আদরের বইমেলায়, আমাদের ভালবাসার বইমেলায় দেখে শুনে অনেকেই রেগে যান, আমি কিন্তু বেশ উপভোগ করি রসিয়ে।
Be the first to comment