শুক্রবার ১১ জানুয়ারি লালগোলায় মদন মোহন রায় মঞ্চে লালগোলা বঙ্কিম স্মৃতি চর্চা সমিতির উদ্যোগে অনুষ্ঠিত হলো বঙ্কিম স্মরণ উৎসব ২০১৮। সকালে এক বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা বের হয়। স্কুলের ছাত্র-ছাত্রী থেকে স্থানীয় মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের ফলে শোভাযাত্রা দীর্ঘ তর হয়। সারাদিনব্যাপী অঙ্কন প্রতিযোগিতা, চিত্র প্রদর্শনী, আলোচনা সভা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, পুরস্কার প্রদান চলে। ফিতে কেটে এই উৎসবের উদ্বোধন করেন লালগোলা থানার ভারপ্রাপ্ত ওসি সৌম দে। ছিলেন আরকিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার সুপারিনটেনডন্ট সোমনাথ জানা, লালগোলা পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি জাহাঙ্গির মিঞা, মুর্শিদাবাদ মিউজিয়ামের কিউরেটার মৌসুমী ব্যানার্জি প্রমুখ।
সোমনাথ জানা জানান, ঐতিহাসিক দিক থেকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য লালগোলায় লুকিয়ে আছে। গবেষক সুমনকুমার মিত্রর সংগৃহীত তথ্য রাজ্য সরকার ও কেন্দ্রীয় সরকারকে জানিয়েছি। আরকিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া প্রিলিমিনারি রিপোর্ট দিয়েছে। সেই রিপোর্টে লালগোলার তথ্য যে সঠিক তার উল্লেখ আছে।
সংগঠনের সভাপতি শেখরকুমার ঘোষ বলেন, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে বহরমপুরে আসেন। এখানে তিনি ৩ মাস ছিলেন। গুপ্তহত্যার চক্রান্ত হয়েছিল বঙ্কিমচন্দ্রের বিরুদ্ধে। লালগোলার রাজা তা জানতে পেরে তিনি বঙ্কিমচন্দ্রকে রাজ অতিথিশালায় রেখেছিলেন। এখানে বঙ্কিমচন্দ্র সন্ন্যাসীর ছদ্মবেশে ছিলেন। এখানে বসেই তিনি ‘বন্দেমাতরম’ রচনা করেন। তাঁর কালজয়ী উপন্যাস ‘আনন্দমঠ’ রচনার সূত্রপাতও এখানেই। লালগোলার দুর্নাম ঘুচিয়ে ঐতিহ্যবাহী ইতিহাসকে আরও বেশি মানুষের কাছে নিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টা। হেরোয়িনের লালগোলা এই অপবাদ থেকে মুক্ত হতে হবে।
ওসি সৌম্য দে জানান, ‘বন্দেমাতরম’-এর জন্য লালগোলাকে জানুক, চেনা যাক। তাঁর প্রস্তাব, প্রতিটি ঘরের মানুষ সকাল শুরু করুক ‘বন্দেমাতরম’ বলার মধ্য দিয়ে।
গবেষক সুমন কুমার মিত্র-র বক্তব্য—
লালগোলা এক সুপ্রাচীন জনপদ। তাই বহু প্রাচীন ইতিহাস তার আভরণ এবং বহু প্রাচীন ইতিহাসের সে সাক্ষীও বটে। তবে আধুনিক ভারতের ইতিহাসের এক উজ্জ্বল সময়ের সাথে লালগোলা জড়িত। পরাধীন ভারতে স্বাধীনতার যে মূলমন্ত্র ভারতবাসীকে ইংরেজ শাসনের শৃঙ্খল ভাঙতে উদ্বুদ্ধ করেছিল-যা পরবর্তীতে স্বাধীন ভারতবর্ষের জাতীয় স্তোত্র হয়-সেই ‘বন্দেমাতরম্’ সঙ্গীতের রচনাস্থল হল এই লালগোলা এবং এই মহাসঙ্গীত যে উপন্যাসে ব্যবহৃত হয় সেই ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসের সমস্ত পটভূমি লালগোলা ও তদ্-সংলগ্ন এলাকা। সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ১৮৭৪ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে এখানে অবস্থানকালে মাঘী পূর্ণিমা তিথিতে রচনা করেন জাতির বীজমন্ত্র‘বন্দেমাতরম্’ সঙ্গীত। আমি আমার ১৪ বছরের গবেষণায় তার নিশ্চিত প্রমাণ পেয়েছি। সাহিত্যিক হেমেন্দ্রকুমার রায় মহারাজা যোগীন্দ্রনারায়ণ রায় ও সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্রের সম্পর্কের কথা বলেছেন তাঁর লেখনীতে, ‘লালগোলার কুমার ধীরেন্দ্রনারায়ণ রায় যখন রাজা উপাধি লাভ করেননি, তখন থেকে একান্তভাবেই সাহিত্য সেবা করে আসছেন। এই সাহিত্য অনুরাগের উৎস কোথায় তা অনুমান করা কঠিন নয়। তাঁর পিতামহ দানবীর মহারাজা রাও যোগীন্দ্রনারায়ণ রায় অবাঙালি হয়েও বাংলাদেশে এসে মনে প্রাণে খাঁটি বাঙালি হয়ে গিয়েছিলেন। তিনি যে বাংলা সাহিত্যের কতবড় বন্ধু ছিলেন, সেকথা এখানে নতুন করে বলবার দরকার নেই। বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদে তাঁর স্মরণীয় অবদান আছে। অসংখ্য সাহিত্যিক অলংকৃত করতেন তাঁর আসর। এমনকি সাহিত্য গুরু বঙ্কিমচন্দ্র পর্যন্ত কিছুদিনের জন্য তাঁর আতিথ্য স্বীকার করে রাজবাড়িতে বসে রচনা করেছিলেন ‘আনন্দমঠে’র কিয়দংশ। কিন্তু দুঃখের বিষয় আজও এই স্থান তার সঠিক মর্যাদা পেল না। আজও অবহেলিত বঙ্কিম স্মৃতি ধন্য লালগোলা রাজ গেস্ট হাউস।
এই বিষয়টিকে সামনে নিয়ে আসার জন্য লালগোলায় একটি সংস্থা ‘লালগোলা বঙ্কিম স্মৃতি চর্চা সমিতি’ ২০১৫ সাল থেকে খুব সুন্দর ভাবে কাজ করে চলেছে, তাদেরই উদ্যোগে আরকিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া এই চত্বরটি সার্ভে করে গিয়েছেন। এই সংস্থা কিছু দাবি রেখেছে সরকারের কাছে এই সমস্ত এলাকার উন্নয়নের স্বার্থে ও ইতিহাস কে বাঁচানোর জন্য, সেগুলি হল—
১। অতিথি নিবাসটি ‘বঙ্কিম ভবন’ নামকরণ।
২। অতিথি নিবাসের অভ্যন্তরে— ক) বঙ্কিম সভা গৃহ, খ)বঙ্কিম পাঠাগার, গ) বঙ্কিম মিউজিয়াম,
৩। প্রাঙ্গনে বঙ্কিমচন্দ্র ও মহারাজা যোগীন্দ্র নারায়ণ রায়ের পূর্ণাবয়ব মূর্তি প্রতিষ্ঠা।,
৪। বঙ্কিম উদ্যান
৫। পুরো এলাকাটির সৌন্দর্যায়ন।
৬। সংশ্লিষ্ট এলাকাকে ‘জাতীয় হেরিটেজ’-এর মর্যাদা দেওয়া হোক, স্বীকৃতি দেওয়া হোক ‘জাতীয় পর্যটন কেন্দ্র’ হিসেবে।
৭। লালগোলা রেল স্টেশনের নামকরণ করা হোক ‘আনন্দমঠ’।
৮) লালগোলা-শিয়ালদহ শাখায় ‘বন্দেমাতরম্’ নামে একটি এক্সপ্রেস ট্রেন চালু করা হোক।
দেখুন ভিডিও-
Be the first to comment