বিকেলে উঠোনে মাদুর পেতে গোল হয়ে বসে নারকেল নাড়ু বানাতে বসেছেন মা-দিদি-বৌদিরা। বিশ ত্রিশটা নারকেল মালা কুরতে কুরতে হাত অবশ। তাই পালা করে চলছে নারকেল কোরা। কেউ নতুন বৌ, কেউ প্রবীণা। কেউ বাপের বাড়ি এসেছেন, কেউ বাপের বাড়ি যেতেই পারেননি। একদিকে পুজোর তোড়জোড়, অন্যদিকে আপন মনে মায়ের মূর্তি গড়ে চলেছেন দুই কারিগর। নিপুণ হাতের ছোঁয়ায় যেন একটু একটু করে জীবন্ত হয়ে উঠছে প্রতিমা। ফি বছর এমনই দৃশ্যের দেখা মেলে সুন্দরবনের নিশ্চিত পুরের গাজির মহল ও অশ্বত্থ তলা গ্রামে।
ধন-সম্পত্তির বাড়বাড়ন্ত কে না চায়। তাই চিরাচরিত উৎসাহ-উদ্দীপনা মেনেই কোজাগরী লক্ষ্মী আরাধনা হল ঘরে ঘরে। বছরভর দর্জির কাজ করেই সংসারের বোঝা টানেন গাজির মহলের জগন্নাথ মণ্ডল ও অশ্বত্থ তলা গ্রামের সুদীপ মণ্ডল। মাঝেসাঝে দু’একটা টিউশনি। কিন্তু, মূর্তি গড়ায় হাত পটু। তাই দুর্গাপুজোর পরই শুরু হয়ে যায় সাজো সাজো রব। বছরের এই কটা দিন লক্ষ্মী মূর্তি বানিয়েই সারা বছরের ভাঁড়ারে সঞ্চয় বাড়ানোর কিঞ্চিৎ প্রচেষ্টা।
শরৎ পূর্ণিমার স্বপ্নিল আলে দু’জনেরই চোখে। কুল্পি থানার নিশ্চিন্তপুরে গাজির মহলের দর্জি বাড়িতে তাই উৎসাহের অন্ত নেই। জগন্নাথ বললেন, ‘‘সারা বছর দর্জির কাজ করি। শরৎকাল আসলেই তাই পোয়াবারো। প্রতিমা বানিয়ে দু’টো অর্থ উপার্জন হয়।’’ তবে শিল্পীর সত্বা যে শুধু টাকা উপার্জনেই সীমাবদ্ধ নয়, নিজের কাজ দিয়ে সেটা বরাবরই প্রমাণ করে আসছেন জগন্নাথ। তাঁর কথায়, শিল্পীর কাজ প্রতিমাকে নিত্য নতুন রূপ দেওয়া। মায়ের আদলেই হোক বা রূপটানে, জগন্নাথের শিল্পী মনের ছোঁয়ায় প্রতিবছরই গাজির মহলের প্রতিমার কদর বাড়ে।
সদ্য উচ্চমাধ্যমিক পাশ করেছেন নিশ্চিত পুরের অশ্বত্থ তলার সুদীপ মণ্ডল। সংসারে হাজারো অভাব। নুন আনতে পান্তা ফুরোয়। তাই ভছরকার এই দিনে মূর্তি গড়ে দু’পয়সা রোজগার করেন সুদীপও। বললেন, ‘‘নতুন কিছু করতে ইচ্ছা করে। ছোট থেকেই মূর্তি গড়ি। চেষ্টা করি প্রতিবারই নতুন নতুন বৈচিত্র্য আনতে।’’
জগন্নাথ হোক বা সুদীপ, দু’জনেরই এ বছরের থিম পুঁথি, তালপাতা ও পেরেক দিয়ে প্রতিমার অঙ্গসজ্জা। দু’জনেই জানালেন, শাড়ি, সালোয়ারের মতো মেয়েদের নানা পোশাকের উপর যে জরির বুনোন থাকে তার মধ্যে থেকে পুঁথিগুলো বেছে নিয়ে সেগুলিকেই প্রতিমা তৈরির কাজে লাগানো হয়। সেই সঙ্গে দরকার হয় তালপাতা এবং পিতলের সীট। জগন্নাথের কথায়, পুঁথি ও তালপাতা নিখুঁত ভাবে বুনে মূর্তির সাজসজ্জায় লাগানো হয়। প্রতিমার মুকুট থেকে ঝাঁপি, শাড়ির পাড়ে পুঁথি আর তালপাতা বুনোটে অন্যরকম শোভা পায় দেবীমূর্তি। জেলার নানা জায়গা তো বটেই, ডায়মন্ড হারবার, ফলতা, সোনারপুর থেকে ক্রেতারা এসে এই সব মূর্তি কিনে নিয়ে যায়। কলকাতার বাজারে এই প্রতিমার ভালোই দর।
সুদীপের কথায়, ‘‘ছোট থেকেই ভাল ছবি আঁকতে পারতাম জানেন। সেটাই নেশা হয়ে গেছিল। অভাবের সংসার, তাই মূর্তি গড়ব মনে করি। এ বারে আমি পেরেক দিয়ে প্রতিমা তৈরি করেছি।’’ ছোট, বড়, মাঝারি— নানা মাপের লক্ষ্মী প্রতিমার পসরা সাজিয়ে বসেছিলেন দু’জনেই। বেলা গড়াতেই ভিড় জমে ওঠে। দুপুরের মধ্যেই পসরা খালি। তাঁদের মুখের হাসিই বলে দেয় লক্ষ্মীপুজোয় বেশ লক্ষ্মীলাভই হয়েছে দু’জনের। ঘন গাছপাতায় ঘেরা প্রান্তিক গ্রামের উঠোন মায়াবী আলোয় ভরপুর। মায়ের আসা যাওয়ার স্পষ্ট চিহ্ন যেন শিল্পীর তুলিতে বাঁধা।
Be the first to comment