একটা একটা করে ঘণ্টা কাটছে আর ভারী হচ্ছে শহরের বাতাস। প্রতীক্ষার প্রহরের অবসান হচ্ছে। রক্তমাখা এক একটা মাংসপিণ্ড সমাজের দায়বদ্ধতাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে।
কংক্রিটের চাঙড় ভেঙে মধ্য চল্লিশের গৌতম মণ্ডলের দেহটা যখন প্লাস্টিকের শয্যায় ভিতর থেকে বার করে আনা হল চোখ বুঝে ফেললেন ঘটনাস্থলে দাঁড়িয়ে থাকা অনেক মানুষই। কারণ এই দৃশ্য চোখ মেলে দেখার মতো নয়। কারণটা কি শুধু বীভৎসতা? না লজ্জা? সারাদিন গতরে খেটে যাঁরা দু’পয়সা উপার্জন করেন, সেই মানুষগুলোর আপনজনের দিকে চোখ তুলে তাকাবার লজ্জা! প্রৌঢ় গৌতম মণ্ডলের ছেলে তোতনের অসহায়, কান্না ভেজা চোখ দু’টোর দিকে তাকাবার লজ্জা! অন্ধকার নেমে এসেছে যে সদ্য বিধবা অনিতাদেবীর জীবনে তাঁর দিকে তাকাবার লজ্জা! এ লজ্জা সমাজের।
কলেজ স্ট্রিট থেকে বই কিনে ফেরার পথে মাঝেরহাট সেতু ভেঙে মৃত্যু হয়েছিল বেহালার শীলপাড়ার সৌমেন বাগের। সেতুর একাংশ হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়ে মাথায় চোট পেয়েছিলেন সৌমেন। ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয়েছিল তাঁর। আরও মানুষ আটকে থাকার আশঙ্কায় তার পরেই চলেছিল তল্লাশি অভিযান। নামানো হয়েছিল স্নিফার ডগ। বুধবার সন্ধেয় উদ্ধার হয়েছিল ঠিকা কর্মী বছর চব্বিশের প্রণব দে’র দেহ। বৃহস্পতিবার সকালে উদ্ধার হল বছর পঁয়তাল্লিশের গৌতম মণ্ডলের ক্ষতবিক্ষত দেহ। দু’জনেরই বাড়ি মুর্শিদাবাদে।
মুর্শিদাবাদের তেঁতুলিয়ায় বাড়ি গৌতম মণ্ডলের। মেট্রো ঠিকা কর্মীর কাজ করার জন্য কলকাতায় আসেন তিনি। পরে তাঁর সঙ্গে কাজে যোগ দেয় ছেলে তোতনও। মাঝেরহাট সেতুর নীচেই একটি অস্থায়ী শিবিরে জনা কয়েক ঠিকা শ্রমিকের বাস। সারা দিন কাজ, দিনের শেষে ঝুপড়ি ঘরেই ক্লান্তির ঘুম। তোতন জানিয়েছে, তাঁর বাবা ঠিকা শ্রমিকদের রান্নার কাজ করতেন। প্রতিদিনের মতো মঙ্গলবারও রান্না চাপাতে সেতুর নীচের ঝুপড়িতে আসেন। কিছুটা দূরেই অন্য শিবিরে ছিল তোতন। সেতু ভাঙার পুরো ঘটনাই ঘটেছে তার চোখের সামনেই। পলকা তাসের ঘরের মতো আস্ত একটা সেতু ভেঙে তার বাবাকে চাপা পড়তে দেখেছে সে নিজের চোখেই।
গোটা ঘটনার সাক্ষী থেকেছেন আরও কয়েকজন ঠিকা শ্রমিক। তাঁদের মধ্যে একজন রঞ্জিত ঘোষ। জানালেন, তিনি এবং আরও কয়েকজন মিলেই গৌতম মণ্ডল এবং প্রণব দে’র দেহ ভিতর থেকে বার করে এনেছেন। ঝুপড়িতে থাকতেন একই সঙ্গে। ভাবলেশহীন মুখ। চোখের জল মনে হয় শুকিয়ে গেছে। রক্তের সম্পর্ক না হলেও দিনের শেষে ক্লান্তি ভাগ করে নেওয়ার দুই সঙ্গীকে হারিয়েছেন। কষ্টটা কোনও অংশেই কম নয়। রঞ্জিত বললেন, “আমাদের দু’জন ছিল ঝুপড়িতে। আমরাই তাঁদের দেহ বার করি। মালিক ৪০ হাজার টাকার চেক দিয়েছিল। সেটা ব্যাগে পুরে আমাদের ঘরের কম্বলের তলায় রেখেছিলাম। সেটা আর পেলাম না।”
অতএব, সব মিলিয়ে মৃতের সংখ্যা দাঁড়াল তিন। জখম জনা সাতাশ। হাতপাতালে এখনও বাঁচার লড়াই চালাচ্ছে আরও ১৩। উদ্ধারকারী দল জানিয়ে দিয়েছে আর কেউ সেতুর নীচে আটকে নেই। মানে অপেক্ষার অবসান হল। সৌমেন বাগের মা আর পথ চেয়ে থাকবেন না কখন তাঁর ছেলে বই কিনে বাড়ি ফিরবে। তোতনের মতো ধ্বংসস্তূপের সামনে বসে কেউ ভাববে না, ‘‘বাবা বেঁচে আছে তো? মা’কে কী বলব?’’ প্রিয় মানুষগুলোর থেঁতলানো দেহ দেখে চোখ বন্ধ করতে হবে না কোনও মা, ছেলে বা স্ত্রীকে। মাঝেরহাটের অধ্যায় শেষ হল। দোষারোপের পালাও থেমে যাবে। কিন্তু আবারও একটা বিপর্যয় ঘটবে না তো শহরে? মাঝেরহাটের মতো অনেক সেতুই তো নড়বড়ে, রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ধুঁকছে। আবারও হুড়মুড়িয়ে মাথার উপর পাহার ভেঙে পড়বে না তো কোনওদিন? তখন সেখানে আমি থাকব না তো? বা আমার কেউ?
Be the first to comment