গতকাল উপরাষ্ট্রপতি বেঙ্কাইয়া নাইডুর কাছে গিয়ে রাজ্যসভার সাংসদ পদ থেকে ইস্তফা দেন মুকুল রায়। তারপর এক সাংবাদিক বৈঠক করে সমস্ত পদ ছেড়ে দিচ্ছেন বলে জানান। অর্থাৎ তিনি আর তৃণমূল কংগ্রেসে নেই। দিল্লিতে মুকুল রায়ের এই সাংবাদিক সম্মেলনের পর কলকাতার তৃণমূল কংগ্রেস ভবনে দলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় বলেন, কাঁচরাপাড়ার কাঁচা ছেলে চলে গেল, তাতে দলের ভালোই হলো। মুকুল রায়ের তোলা প্রশ্নগুলির উত্তর মা-মাটি-মানুষ পত্রিকার সম্পাদকীয় বিভাগে প্রকাশিত হচ্ছে। সম্পাদক দেবাশিস ভট্টাচার্যের লেখাটি আমরা হুবহু তুলে দিলাম।
১১ অক্টোবর ২০১৭। মুকুল রায় রাজ্যসভার সদস্যপদে ইস্তফা দেন। তারপর দিল্লিতে সাংবাদিক বৈঠক করে তিনি কিছু কথা বলেন। শুরু করেন ‘ইট ইজ হিস্ট্রি’ বলে। তিনি বলেন, কংগ্রেসের বিরোধিতা করার জন্যই তৃণমূল কংগ্রেস দল তৈরি হয়েছিল। তাহলে এখন আবার কেন কংগ্রেসের সঙ্গে সখ্যতা করা হচ্ছে? আমাদের উত্তর, কংগ্রেসের বিরোধিতা করার জন্য তৃণমূল কংগ্রেস তৈরি হয়নি। সিপিআইএমকে ক্ষমতাচ্যুত করার লড়াইয়ে কংগ্রেস সক্রিয় ছিল না বলেই তৃণমূল কংগ্রেস দল তৈরি করতে হয়েছিল।
তাঁর দ্বিতীয় অভিযোগ, টিএমসি কখনও বিজেপি, কখনও কংগ্রেসের সঙ্গে গেছে। লাইনের কোনও সামঞ্জস্য নেই। মানুষের স্বার্থে কাজ করতে হলে পার্টির বিকাশ দরকার। জনগণের আশীর্বাদে সরকারি ক্ষমতায় যাওয়ার সুযোগ পেলে তার সদ্ব্যবহার করাও দরকার। ২০ বছরে তৃণমূল কংগ্রেসের শক্তি বৃদ্ধি পেয়েছে, না কমেছে? বৃদ্ধি পেয়েছে। বৃদ্ধি পেলে বুঝতে হবে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ঘটনায় এবং বিভিন্ন ভোটে টিএমসি যে রণকৌশল নিয়েছে তা সঠিক।
মুকুলবাবু বলেছেন, ১৯৯৮ সালের লোকসভা ভোটে টিএমসি আসন সমঝোতা করে বিজেপির সঙ্গে। সাতটি আসন জেতে। তারপর বাজপেয়ীর ১৩ দিনের সরকারকে বাইরে থেকে সমর্থন করে। ইট ইজ নট হিস্ট্রি। বাজপেয়ীর ১৩ দিনের সরকার হয়েছিল ১৯৯৬ সালের মে মাসে। ১৯৯৯ সালের লোকসভা ভোটের পর টিএমসি এনডিএ সরকারে যোগ দেয়। ২০০১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে এনডিএ সরকার ছাড়ে। স্বয়ং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আগেই বলেছেন, ওই সিদ্ধান্তটি ভুল ছিল। যে কাজ করে তারই ভুল হয়।
মুকুলবাবুর অভিযোগ, ২০১২ সালের সেপ্টেম্বরে ইউপিএ ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল ফ্লিমসি গ্রাউন্ডে। এই অভিযোগ মারাত্মক। কারণ পাতালের কয়লা উত্তোলন, খুচরো ব্যবসা থেকে আকাশে বিমান চলাচল সব কিছুতেই বিদেশি পুঁজি লগ্নির বিরোধিতা করে টিএমসি সঠিক সিদ্ধান্তই নিয়েছিল। তা না হলে ২০১৪ সালের লোকসভা ও ২০১৬ সালের বিধানসভা ভোটে এত আসন পেতো না। ওই গ্রাউন্ড মোটেই ফ্লিমসি ছিল না।
দলের শক্তিবৃদ্ধির জন্য সুবিধাবাদ না করে নমনীয় কৌশল প্রয়োগ করে এগোনোই যোগ্য ও দক্ষ নেতৃত্বের গুণ। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ২০০৬-০৭ সালে সিঙ্গুর ও নন্দীগ্রাম আন্দোলনের সময় বহু ছোটো গোষ্ঠী ও ব্যক্তির সঙ্গে হাত মিলিয়ে কৃষিজমি ও জীবন-জীবিকা রক্ষা কমিটি তৈরি করেছিলেন। একদম ঠিক পদক্ষেপ ছিল। এর জন্যই ২০০৮ সালের পঞ্চায়েত ও ২০০৯ সালের লোকসভা ভোটে সাফল্য এসেছিল। চলমান রাজনীতির প্রতিটি বাঁকে রণকৌশল সঠিক ছিল, তার প্রমাণ ২০০৯ এবং ২০১১ সালে কংগ্রেসের সঙ্গে জোট গড়ে লড়ে সাফল্য আসে। আবার ২০১৪ এবং ২০১৬ সালে একলা লড়ে টিএমসি আরও সাফল্য পায়। প্রথমটির পেছনে কারণ ছিল সিপিআইএমের শাসনের বিরুদ্ধে মমতার একটানা লড়াই, সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের কৃষক আন্দোলনে নমনীয় কৌশল অবলম্বন করে লড়াই এবং তখনকার ভোটে কংগ্রেসের সঙ্গে জোট গড়া। আবার ২০১৪ সালে এবং ২০১৬ সালে সাফল্য এসেছে রাজ্য সরকারের উন্নয়নের জোয়ারে।
মুকুলবাবুর বক্তব্য, ১৯৬৬ সালে অতুল্য ঘোষ বলেছিলেন অজয় মুখোপাধ্যায় সাগরে তলিয়ে যাবেন। কিন্তু সেই অজয় মুখোপাধ্যায়ই দু-বার মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন। এর উত্তরে আমরা বলছি, (ক) অজয়বাবু তিন বার মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন, (খ) ১৯৬৭ এবং ২০১৭ রাজনৈতিক পরিস্থিতির মিল ১০ শতাংশও নয়, (গ) ১৯৬৭ সালে বাংলা কংগ্রেস ৩৬টি আসন জিতেছিল, সিপিআই, ফরওয়ার্ড ব্লক, এসএসপি, পিএসপির সঙ্গে মোর্চা গড়ে। সেই মোর্চা না গড়লে বাংলা কংগ্রেস সত্যিই সাগরে তলিয়ে যেতো। মুকুলবাবুর মতন অভিজ্ঞ সংগঠক কী করে ১৯৬৭-র রাজনীতি ২০১৭-য় চলবে বলে ভাবছেন?
তাঁর আরও অভিযোগ, তৃণমূল কংগ্রেস ১৯৯৮ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত বিজেপিকে সাম্প্রদায়িক বলেনি, ২০১৪ সাল থেকে ওই তকমা দেওয়ার মানে কী? বাজপেয়ী এমন এক জন প্রধানমন্ত্রী যিনি নিজের দলের গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে বলেছিলেন, রাজধর্ম পালন করো। এটাতেই পার্থক্য প্রমাণিত হয়। মোদী চাইছেন বিরোধীমুক্ত ভারত। আর বাজপেয়ী তেইশটি দলের কোয়ালিশন সরকারকে ৫ বছর টিকিয়ে রেখেছিলেন।
মুকুলবাবু সবশেষে বলেছেন, বাংলার ৭৭,৪০০ বুথেই তাঁর লোকজন আছে। সাংবাদিক সম্মেলনের শুরুতেই তিনি ১৯৯৭ সালে নির্বাচন কমিশনে পেশ করা চিঠি ও সার্টিফিকেটের জেরক্স দেখান। এ থেকে বোঝা যায় যে, দলের সাধারণ সম্পাদক হয়েও ইনি প্রয়োজনে কাজে লাগতে পারে বুঝে গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র নিজের কাছে রাখছিলেন। এতে প্রমাণিত হয়, দলের প্রতি তাঁর আনুগত্য ষোলো আনা ছিল না। এবং রাজ্যের সব বুথে তাঁর দু-চার জন করে লোক থাকা মানে বুঝতে হবে, তিনি দলের মধ্যে থেকেও উপদলীয় কাজকর্ম এবং সমান্তরাল সংগঠন গোপনে চালিয়ে গেছেন। এটা যে কোনও গণতান্ত্রিক দলের পক্ষে মারাত্মক অপরাধ।
প্রাথমিকভাবে যেটি তৃণমূল কংগ্রেস পার্টি বনাম ব্যক্তি মুকুলবাবুর মত বিরোধ বলে মনে হচ্ছে, আসলে সেটি মমতা ও মুকুলবাবুর ভাবনাচিন্তা তথা লাইনের লড়াই। সব দেশে সব কালে সব পার্টিতেই এই দুই লাইনের লড়াই হয়েছে। এই দুই লাইনের লড়াইয়ে মমতাই ঠিক।
Be the first to comment