উত্তরপ্রদেশ বিধানসভা নির্বাচন দোরগোড়ায়। অথচ ভোট রাজনীতির ময়দানে সেভাবে দেখা যাচ্ছে না বহুজন সমাজ পার্টির (বসপা) নেত্রী মায়াবতীকে। যেটুকুই বা সামনে আসছেন, সেইসময় মূলত সমাজবাদী পার্টিকেই নিশানা করছেন। বাকি সময়টুকু কংগ্রেসকে আক্রমণ। কিন্তু বিজেপিকে নিয়ে এখনও পর্যন্ত সেভাবে মুখই খোলেননি তিনি। বসপা সুপ্রিমো প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হিসাবে সপাকেই সামনে রেখেছেন, তা ইতিমধ্যেই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে।
ভোটের দু’দফার প্রার্থী তালিকায় সপার মুসলিম প্রার্থীর বিরুদ্ধে নিজের দল থেকে মুসলিম প্রার্থী দিয়ে মায়া যে ভোট কাটাকাটির খেলায় নেমেছেন, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু এই ভোট কাটাকাটির খেলায় যে বিজেপি লাভবান হবে সেই অঙ্ক পোড় খাওয়া রাজনীতিবিদ মায়া জানেন না, এমনটা হতে পারে না। কীসের ‘মোহ’য় মায়া এই কাজ করছেন তার উত্তর খুঁজছে রাজনৈতিক মহল। অনেকে বলছেন, বিজেপির সঙ্গে গোপন আঁতাত হয়েছে বসপা নেত্রীর। তাঁর পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে যে সমস্ত আর্থিক দুর্নীতির তদন্ত চলছে, আপাতাত তাতে দাঁড়ি টানার লক্ষ্যেই সপার বিপক্ষে গিয়ে বিজেপিকে সুবিধা করে দিচ্ছেন তিনি।
পাশাপাশি এবার উত্তরপ্রদেশ ভোটে যে সরাসরি সপা ও বিজেপির মধ্যে মুখোমুখি লড়াইয়ের পরিস্থিতি তৈরি হয়ে গিয়েছে, সেই বিষয়টি আন্দাজ করে যেভাবেই হোক সপাকে ক্ষমতা দখলের রাস্তা থেকে সরানোর উপরেই মায়া জোর দিচ্ছেন বলে মনে করা হচ্ছে। বসপা উত্তরপ্রদেশে ক্ষমতা দখল করতে পারবে না, বরং সপা ক্ষমতায় এলে তাঁর বিপদ বাড়বে এই আশঙ্কা থেকেই সপাকে ক্ষমতার অলিন্দ থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে মায়ার ‘খেলা’ শুরু হয়ে গিয়েছে।
সেই খেলার অংশ হিসেবেই বহেনজি নিজের দলিত ভোট ব্যাংক বিজেপির ঘর থেকে নিজের দিকে ফেরানোর চেষ্টার উপরেও বিশেষ একটা জোর দিচ্ছেন না। উত্তরপ্রদেশের লোকজন মজার ছলে বলছেন, দলিতদের ভোটেও মায়ার অরুচি হয়েছে। আসলে বিষয়টি তা নয়। মায়া ভালভাবেই জানেন দলিতদের মধ্যে তাঁর যে ‘কোর’ ভোট ব্যাংক জাটব শ্রেণি, তাঁর নিজের জাতের ভোটাররা বসপার সঙ্গ ছাড়বে না কারণ, তারা কোনও দিনই ছাড়েনি।
২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে বসপা উত্তরপ্রদেশ থেকে একটিও আসন পায়নি। তবু মায়ার দল প্রায় ২০ শতাংশ ভোট পেয়েছিল। আবার ২০১৭ সালে উত্তরপ্রদেশ বিধানসভা নির্বাচনে বসপা ৪০৩টি আসনের মধ্যে মাত্র ১৯টি আসন পেলেও ২২ শতাংশ ভোট পেয়েছিল। উনিশের লোকসভা নির্বাচনে ১০টি আসন পাওয়া সত্ত্বেও তাদের ভোট শতাংশ ছিল সেই ২০ শতাংশের কাছাকাছিই। সে কারণেই নির্বাচনের পরে সপার সঙ্গে জোট করে তাঁদের কোনও লাভ হয়নি বলেই প্রকাশ্যে অভিযোগও করেছিলেন মায়াবতী। রাজ্যের প্রায় কুড়ি শতাংশ ভোট বসপার ঘরে আসবে সেই বিষয়টি যেমন মায়ার জানা, তেমনই আবার এই কুড়ি শতাংশের ভোটের উপর ভর করে তিনি উত্তরপ্রদেশে ক্ষমতা দখল করতে পারবেন না সেই বিষয়টিও অজানা নয়।
তাই যে কোনও প্রকারে রাজ্যে মূল প্রতিপক্ষ সপাকে আটকানোই মায়ার লক্ষ্য। সপার মুসলিম প্রার্থীর বিরুদ্ধে মুসলিম, দলিত প্রার্থীর বিরুদ্ধে দলিত প্রার্থী- এই ফর্মুলা নিয়েই তিনি চলছেন। আগামিদিনেও তেমনই চলবেন বলে মনে করা হচ্ছে। রাজ্যের প্রায় ২১ শতাংশ দলিত ভোটের মধ্যে সিংহভাগই, ৫৫ শতাংশ জাটব। বাকি ৪৫ শতাংশের মধ্যে পাসি, ধোবি, বাল্মিকীরা বিজেপির দিকে ঝুঁকে রয়েছেন। আবার খাটিক, কনোজিয়া, কোল ও অন্যান্যারা সপা, কংগ্রেস বা অন্য রাজনৈতিক দলের সঙ্গে রয়েছে। ভোটের ময়দানে দলিতদের থেকেও ওবিসি সম্প্রদায়ের ভোটের উপরেই ক্ষমতা দখের লড়াই নির্ভর করে। দলিতরা সঙ্গে থাকলেও ওবিসিরা বসপার সঙ্গ অনেক আগেই ছেড়ে দিয়েছে।
২০১২ সালে ওবিসিরা সপার সঙ্গে থাকায় রাজ্যের ওবিসি সংরক্ষিত ৮৬টি আসনের মধ্যে ৫৮টি সপার দখলে গিয়েছিল। আবার ২০১৭ সালে বিজেপির ঘরে গিয়েছিল ৭৮টি আসন। অথচ ২০০৭ সালে ৬২টি আসন বসপার দখলে ছিল। এককথায় ওবিসি আসনের সিংহ ভাগ যাদের দখলে থাকবে তারাই উত্তরপ্রদেশ সরকার গঠন করবে, এমনটাই ধারা চলে আসছে। সেই ধারায় যেন সপা যাতে আগের মতো ওবিসি ভোট ব্যাংক নিজেদের দখলে না আসতে পারে সেদিকেও নজর রয়েছে বসপা নেত্রীর। আগামী দফার প্রার্থীতালিকায় সপার ওবিসি ভোটে ভাগ বসানোর খেলাই দেখাবেন মায়া, মনে করছেন রাজনৈতিকমহলের একাংশ।
Be the first to comment