নারী দিবসের প্রয়োজনীয়তা আছে কি? কি বলছেন বিশিষ্ট মহিলারা

Spread the love

মিতালী মিত্র, কর্ণধার, লিভস এ্যান্ড অ্যারোমা টি রুম

মিতালী মিত্র, নামের অর্থ বন্ধুতা। হ্যাঁ খুব ভালো বন্ধু মিতালী কিন্তু জীবনের লড়াই লড়েছেন একার হাতে। একাই থাকেন মিতালী। অবশ্য তা নিয়ে কোনো জাহির নেই। বলেন, তোরা বন্ধুরা তো আছিস। আমাদের যখন স্কুল বেলা তখন থেকেই মিতালী সাংবাদিকতা করেন। এডুকেশন বিটে মিতালীর মতো দক্ষ সাংবাদিক বাংলায় খুব কম জনই আছেন। প্রিন্ট, ইলেক্ট্রনিক দুই ধরণের মিডিয়াতেই কাজ করেছেন। আমাদের রোজদিন ওয়েবে সময় পেলে লেখেন। এই মিতালীর হঠাৎ ইচ্ছা হয়েছিল হোম স্টে করার। সাংবাদিকতায় আর্থিক নিরাপত্তা না থাকায় পাহাড়ে পাড়ি জমান তিনি। বেশ কিছু হোম স্টেতে থাকেনও। ঠিক করে ফেলেন এই ব্যবসাই করবেন। যাই হোক আত্মীয় বন্ধু বান্ধবদের স্বনির্বন্ধ অনুরোধে মিতালী ফিরে আসেন কলকাতায়। পাহাড়ের চড়াই-উৎরাই, পাকদন্ডী পথ মিতালীকে শিক্ষা দেয় জীবন চলতে গেলে উত্থান পতন দুই আছে। ব্যবসা করার ইচ্ছাটা আরও প্রবল হয়। ঝাঁপিয়ে পড়েন কিছু করার তাগিদে। আমরা যারা মিতালীকে চিনি তারা জানি মিতালী চা অন্ত প্রাণ। সারাদিনে কতবার যে চা খান তা গুনে শেষ করা যায় না। সুতরাং সেই চায়েরই বুটিক খুললেন নিউ টাউনের ইকো পার্কে। সঞ্চিত সামান্য অর্থ, কিছু ব্যাঙ্ক লোন, মা-এর গয়না সবকিছু দিয়ে গড়ে তুললেন লিভস এ্যান্ড অ্যারোমা টি রুম। অবশ্য কিছু বন্ধু স্থানীয় মানুষ সাহায্যের হাত অবশ্যই বাড়িয়ে দিয়েছেন।

নারীদিবসের প্রয়োজনীয়তা কতটা মিতালীকে জিজ্ঞেস করাতে তিনি বলেন, নারীর ক্ষমতায়নের প্রক্রিয়া চলছে, কিন্তু সম্পূর্ণ ক্ষমতায়ন তো আমাদের দেশে বা রাজ্যে হয়নি। যারা বালিতে মুখ গুঁজে থাকেন তাদের ধাক্কা দেওয়ার জন্য এরকম একটা দিনের প্রয়োজন আছে।

মিতালী মনে করেন নারী স্বাধীনতা তখনই হয় যখন সে নীতি নির্ধারনের অধিকার পায়। বাইরের জগতের কথা বাদ দিন আমাদের নিজেদের ঘরেই এই অধিকার কি পায় নারীরা? মা-কাকিমা-জ্যেঠিমা-ঠাকুমারা সংসার সামলান, রান্নাঘরে কি কি রান্না হবে সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু বাড়িতে মেয়ে বা ছেলের বিয়ে যখন ঠিক হয় তখন গৃহকর্তার সিদ্ধান্তই সর্বশেষ বলে মনে করা হয়। তবে কোথায় স্বাধীনতা? স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও তাঁর পুত্র-কন্যার বিয়ে ঠিক করে তবেই স্ত্রী মৃণালিনী দেবীকে জানাতেন।এর পরিবর্তন এখনও খুব একটা হয়েছে বলে মনে হয় না।

নিম্নবিত্ত পরিবারের ক্ষেত্রে কিছুটা অন্যরকম ছবি। সেখানে মহিলারা রোজগার করেন বলে তাঁর ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা করান, বিয়ের ক্ষেত্রেও সিদ্ধান্ত নেন। অবশ্য এ কথা ঠিক, রোজগার করা সত্ত্বেও বরের পিটানি জোটে কপালে। তবু সে অনেক ক্ষেত্রেই স্বামীকে ছাড়ে না। কারণ সে তার কাছে একটা খুঁটি, একটা প্রোটেকশন। পঞ্চায়েত মহিলা প্রতিনিধিত্ব পেলেও বর-ভাসুর-শ্বশুর সে মেয়েটিকে পুতুল করে রাখে। যদিও এখন পরিস্থিতির বেশ কিছু পরিবর্তন হচ্ছে। তাদের নিজেদের আত্মমর্যাদা, আত্মবিশ্বাস বাড়ছে।

শিক্ষা একটা বিশেষ ভূমিকা পালন করে ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে। গ্রামের দরিদ্র মেয়েরা বয়স্ক শিক্ষাকেন্দ্রে পড়ে নিজেদের টাকার হিসেব নিজেরাই রাখছে, কেউ তাদের ঠকাতে পারবে না। মুর্শিদাবাদে গিয়ে আমি দেখে এসেছি কিভাবে পরিশ্রম করে মায়েরা রোজগার করে মেয়েদের পড়াচ্ছেন। স্কুলে টিচার ঠিক সময়ে না এলে মা প্রতিবাদের ঢঙে বলছেন, মাস্টার ক্যানে যাচ্ছে না, বলেন মিতালী। আমি পড়তে পারেনি কিন্তু আমার পরের প্রজন্মকে পড়াবো সেই বোধ এসে গেছে। শহুরে মধ্যবিত্ত পরিবারে কিছু সামাজিক ট্যাবু আছে। আমরা অনেকে লোক লজ্জার ভয়ে অনেক কিছু বলতে পারিনা। যৌন নির্যাতন থেকে শুরু করে নানা ধরণের প্রতারণের শিকার হন মধ্যবিত্ত মেয়েরা। কিন্তু ওই যে মিডল ক্লাস সেন্টিমেন্ট, সমাজ কি বলবে? এই জায়গা থেকে বেরোতে হবে। মিতালী বলেন, আমি বলছি সবসময় আলাদা থাকতে হবে তা নয়, নীতি নির্ধারকের ভূমিকায় অবশ্যই মেয়েদেরই রাখতে হবে। এরজন্য যোগ্যতা, দক্ষতা, শিক্ষা অর্জন করেছে মেয়েরা। ভবিষ্যতে আরও করবে। ছোট শিশুরা এখন যৌন লালসার শিকার হচ্ছে সেটা এখন বলে নয় সব যুগেই শিশু কিশোরীরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পরিবারের লোকেদের দ্বারা যৌন হেনস্থার শিকার হন। এই বীভৎসতা, এই মনের বিকার সমাজকে কলুষিত করে। সেই জন্য ছোট মেয়েটির সঙ্গে বাবা-মাকে ভালোভাবে মিশতে হবে, মা যেন হয় তার বন্ধু।

পোশাক পড়ার স্বাধীনতা কতটা থাকবে তা নিয়ে বারে বারে প্রশ্ন উঠেছে। মিতালী বলেন, আমরা নিজেরা যেটা ক্যারি করতে পারবো সেটাই আমরা পড়বো। কারোর অন্ধ অনুকরণ নয়। মিতালীর মতে মেয়েরা ছেলেদের সমকক্ষ বলা মানেই তো তুলনা এসে গেল মানে মেয়েদের অপমান করা হলো তারা নিজেদের স্বতন্ত্র অস্তিত্ত্বের মাথা উঁচু করে বাঁচবে। মিতালী সাংবাদিকতার অভিজ্ঞতা কিছু শেয়ার করে বলেন, বামপন্থীরা নিজেদের প্রগতিশীল বলা সত্ত্বেও লিডারশিপে মেয়ে কম আসে এই অজুহাতে যে সংসার দেখবে কে? অনেক সংবাদপত্র বা ইলেক্ট্রনিক মিডিয়াও বর্তমানে মেয়েদের নিতে চায় না। কিছু কিছু হাস্যকর যুক্তি দেওয়া হয়। মেটারনিটি লিভ, শিশু যত্নের জন্য ছুটি এ সবের প্রসঙ্গ তো আসেই, অনেকে আবার একথাও বলেন, আউটডোরে সংবাদ সংগ্রহে যাওয়ার সময় ছেলেরা একটা রুম শেয়ার করে থাকতে পারে কিন্তু মেয়েদের ক্ষেত্রে ফটোগ্রাফার, রিপোর্টার দুটো রুম দিতে হয়, যা কোম্পানীর পক্ষে খরচ সাপেক্ষ হয়ে যায়। ‘প্রতিদিনে’ কাজ করার সময় মিতালী নাইট শিফটেও করেছিলেন, কিছুটা পুরুষ সহকর্মীদের থেকে অভব্য আচরণ নাইটে পাওয়ায় বসকে বলে একজন ডেসকে মহিলা এবং একজন মহিলা রিপোর্টার রাতে কাজ করবে এইরকমই ঠিক হয়। মহিলাদের স্যানিটারি ন্যাপকিন কেনার সময় এখনও আমাদের ফিসফিস করে বলতে হয়। প্যাডম্যানের মত একটা সিনেমা তৈরী করতে হয়। এত ছ্যুৎমার্গ কিসের, এটাতো একটা শারীর বৃত্তীয় প্রক্রিয়া। কন্যা ভ্রূণ হত্যা, লিঙ্গ নির্ধারণ আজও সমাজের সব স্তরেই বিদ্যমান। এর বিরুদ্ধে লড়তে হবে। নিজেদের যোগ্যতা ও ক্ষমতা দিয়ে উত্তরণের পথে যেতে হবে। মালালা ইউসুফজাই এর বক্তব্য দিয়ে লেখা শেষ করছি,

“I raise up my voice not so I can shout, but so that those without a voice can be heard. We cannot succeed when half of us are held back.”

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*