স্বাধীনতা দিবস এবার ৭৫- এ। বিস্মৃত না হোক স্বাধীনতা সংগ্রামের মাহাত্ম্য। মধ্যরাতে আসা স্বাধীনতার আলোতে অনেক আশা, আকাঙ্ক্ষার জন্ম হয়েছিল সেদিন মানুষের মনে। সকলেই নিজের মতন করে দেশকে দেখতে চেয়েছিল। একান্ত আপন মনে করে সাজিয়ে নিতে চেয়েছিল নিজের মাতৃভূমিকে। মনে করছিল দীর্ঘদিন ধরে চলা অত্যাচার এবার হয়তো বন্ধ হতে চলেছে। নীলকর সাহেবদের শোষণ থেকে শুরু করে সর্বত্র উৎপীড়ন আর হবে না। এখন থেকে তো আমরাই আমাদের দেশকে চালনা করব।
এই সংগ্রামের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে জড়িয়ে রয়েছে অনেক নাম। যাঁদের অবদান অনস্বীকার্য। তাঁদের প্রতি আমরা শুধু স্মৃতি-নির্ভর, শপথ-নির্ভর যেন না হয়ে পড়ি। সেদিন বৃটিশ শক্তির বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু হয়েছিল সহিংস ও অহিংস পদ্ধতিতে। দেশ মাতৃকার শপথ নিয়ে উত্তাল গোটা ভারত। একের পর এক বৃটিশের কালা কানুন। তারই মধ্যে বাংলা ভাগের বিরোধিতা করে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনে গর্জে উঠেছিল দেশবাসী। সকলে নিজের নিজের মতন করে প্রতিবাদে সরব। কারও কলম প্রতিবাদ করে উঠেছিল সেদিন। আবার কোনও মানুষ ধিক্কার জানাতে হাতিয়ার করেছিল রং – তুলিকে। সকলেরই লক্ষ্য এক, দেশকে বৃটিশ শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করা।
সেসময় কার্জনের বাংলা ভাগের সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে উত্তাল হয়ে ওঠে তিলোত্তমা। দেশের রাজধানী তখনও স্থানান্তরিত হয়নি। শিক্ষা, সংস্কৃতির পীঠস্থান এই শহর। দেশের নানা প্রান্তের কৃতি ছাত্রদের অবস্থান এখানে। তেমনই ১৮৮৪ সালে ৩ রা ডিসেম্বর বিহারের সিওয়ানে জন্ম হওয়া এক কৃতি সন্তান তখন প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্র। খুব স্বাভাবিক ভাবেই বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন তাঁর মনকেও নাড়া দিয়ে ওঠে। ছাত্রাবস্থায় ১৯০৬, কলকাতার বার্ষিক সভায় ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস দলের স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে রাজেন্দ্র প্রসাদের রাজনীতিতে প্রবেশ। ১৯১১ সালে কংগ্রেসের সদস্য পদ লাভ , ১৯১৬ সালে লখনৌতে মহাত্মা গাঁন্ধীর সংস্পর্শে এসে চম্পারনে তথ্যনুসন্ধানের কর্মসূচিতে সাহসিকতা ও কৃতিত্বের পরিচয় দেন।
গান্ধীজির নেতৃত্বে অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দেন তিনি। সেই সময় থেকেই সবসময়ের জন্য জাতীয়তাবাদী রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করেন। বহুভাষী ও নানা ধর্মাবলম্বী মানুষের সম্বন্ধে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গী ছিল খুবই সদর্থক ও স্পষ্ট। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর স্বাধীন ভারতের প্রথম রাষ্ট্রপতি হিসেবে তিনি সেই কাজ করে গিয়েছেন জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত নিরলস ভাবে। ভারতের স্বাধীনতা যুদ্ধে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন এক বড় সন্ধিক্ষণ। নিজের নিজের ক্ষমতায় বৃটিশ বিরোধিতায় সামিল হয়েছিল দেশবাসী।
প্রায় কাছাকাছি সময় ১৮৮৯ সালে জন্ম হয় আরও এক স্বাধীনতা-প্রত্যাশী একরোখা সন্তানের। দেশকে শৃঙ্খল মুক্ত করতে অতি অল্প বয়স থেকেই তিনি শপথ গ্রহণ করেছিলেন। ১৯০৮ সালে বৈশাখের এক সন্ধ্যায়উনিশ বছরের ক্ষুদিরাম বসু আর সদ্য যুবা প্রফুল্ল চাকি অত্যাচারী ম্যাজিস্ট্রেট কিংসফোর্ডকে মারার চূড়ান্ত অভিযানে নেমেছিলেন। ক্ষুদিরামের বোমায় ভুলক্রমে মারা গেলেন কেনেডি ও তার পরিবার। ধরা পড়ে গেলেন তিনি। আর তার পর বিচারে ফাঁসির নির্দেশ হল তাঁর। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রথম শহিদ হলেন ক্ষুদিরাম বসু।
সেসময় শুধু রাজনৈতিক আন্দোলনে সীমাবদ্ধ রইল না বৃটিশ বিরোধী সংগ্রাম। প্রভাব পড়ল শিল্প সংস্কৃতিতে। স্বাধীনতা সংগ্রামে জাতীয় জীবনের গুরুত্ব আছে, এবং জাতীয় জাগরণের ক্ষেত্রে শিল্প জাগরণের বিশেষ প্রয়োজন। শিল্প নিছক বিলাসিতার বস্তু নয়, জাতীয় জীবনে শিল্পের গভীর তাৎপর্য রয়েছে।
এই সময়েই ১৮৳২, ভারতের শিল্পে এক কৃতি সন্তানের জন্ম হয়। নন্দলাল বসু। যৌবনের প্রারম্ভেই তিনি প্রত্যক্ষ করেন বৃটিশ বিরোধী বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন। প্রভাব পড়ে তাঁর মনেও। প্রকাশ ঘটে রং-তুলির মধ্য দিয়ে। ১৯০৫-এ বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের প্রভাবে বাংলায় স্বদেশি হাওয়া জোরালো হয়ে উঠল। অবনীন্দ্রনাথ আঁকলেন ‘ভারতমাতা’। ছবিটি দেখে নিবেদিতার মন্তব্য (প্রবাসী, ভাদ্র, ১৩১৩), ‘এখানে এমন একটি ছবি পাচ্ছি যা ভারতীয় শিল্পে আগামী দিনে এক বিশেষ দিক নির্দেশ করবে।
এরপর অবনীন্দ্রনাথের অনুপ্রেরণায় অনুপ্রাণিত হয়ে তাঁর সেই কাজে সামিল হলেন নন্দলাল বসু। দিনে দিনে তিনি মেতে উঠলেন ছবির আশমানদারিতে। অবনীন্দ্রনাথ নিজের স্টুডিয়োতে কাজের ফাঁকে পুরাণ কথা শোনাতেন ছাত্রদের। তাঁর প্রভাবে নন্দলাল এঁকে ফেললেন, ‘সতী’ নামের ছবি। ধীরে ধীরে ভারতের শিল্প পাশ্চাত্য প্রভাবের বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে দেশীয় ধারায় বহমান হয়ে যেতে লাগলো।
এরপর তিনি মনোনিবেশ করলেন কালীঘাটের পট আর লোকশিল্প নিয়ে। পটুয়া নিবারণ ঘোষদের কাছে গিয়ে অতিদ্রুত রেখা ও রঙের কাজে হাত মকসো করেন তিনি। তিনি অজন্তার ভিত্তিচিত্রের অনুকৃতি কাজ করেন। নিভৃত গুহার অন্ধকারে থামের পর থাম, দেওয়ালের পর দেওয়ালে সুডৌল শিল্প ঐশ্বর্য দেখে নির্বাক তখন নন্দলাল। কলকাতায় ফিরে অজন্তায় আঁকা স্কেচের সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ল। একদিন ডেকে পাঠালেন রবীন্দ্রনাথ। দায়িত্ব দিলেন তাঁর নতুন কবিতার বই ‘চয়নিকা’-র ছবি আঁকার। চয়নিকা ছাপা হল, নন্দলালের ছবি নিয়েই। এরপর রবীন্দ্রনাথ তাঁকে শান্তিনিকেতনে আহ্বান জানিয়ে সংবর্ধনা দিলেন। সেই প্রথম নন্দলালের শান্তিনিকেতন যাওয়া। কবির সঙ্গে শিলাইদহ পথে শাজাদপুরে পদ্মার অপার্থিব সৌন্দর্যকে রেখায় রেখায় স্কেচখাতায় ধরলেন তিনি। নিপুণ রেখায় আঁকলেন ‘শীতের সন্ধ্যার পদ্মা’, ‘জলকে চল’, ‘পোকন মাঝি’। এরপর একে একে এঁকে চললেন ঐশ্বর্যশালী সব ছবি। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ‘সরস্বতী’, হরিপুরা কংগ্রেসে ‘বীণাবাদিনী’, ‘সাঁওতাল ফসল-নৃত্য’…।
এক সময় শুধুমাত্র ব্রিটিশের শাসন থেকে মুক্তি পাওয়াই ছিল স্বাধীনতা আন্দোলনের মূল লক্ষ্য। আজ কিন্তু অন্য অনেক কিছু থেকে মুক্তি পাওয়ার প্রয়োজন বোধ করছে ভারতবাসী । অসহিষ্ণুতা, সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মের নামে হিংসা, নারী নির্যাতন, ধর্ষণ— এই রকম একের পর এক সামাজিক বিষ আজ আমাদের গিলে খেতে চাইছে। এর থেকে মুক্তি অতি অবশ্য জরুরি।
উন্নয়ন হবে, দেশ সামনের দিকে এগিয়ে যাবে। বিশ্বের যেকোনও দেশের সাথে অগ্রগতিতে টক্কর নেবে প্রতি নিয়ত। এই আশাতেই বুক বেঁধেছিল সেদিনের ভারতবাসী। আজ কোথায় যেন একটা বেসুরো বাজছে সেদিনের স্বাধীনতা সংগ্রামী মানুষদের আদর্শের সঙ্গে।
ভারতের মতন বহু ভাষা ও ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের ঐতিহ্য বজায় রাখা জরুরি। আজ দেশের অগ্রগতি প্রয়োজন। কিন্তু তা শুধু বস্তুগত নয়, প্রকৃত অগ্রগতি জরুরি। এর মধ্য দিয়েই মূল্যবোধ, চিন্তাধারারও অগ্রগতি সম্ভব । যা আজ অনেকাংশেই বাধাপ্রাপ্ত। অট্টালিকা সম মূর্তি বা জমকালো উদযাপন নয়, সেই সব মানুষের স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করার মধ্য দিয়েই স্বাধীনতা আন্দোলনের বীর যোদ্ধাদের সম্মান প্রদর্শন করা প্রয়োজন।
Be the first to comment