পবিত্র চক্রবর্তীঃ
১
ক্ষীরপুর নাম প্রথম শুনলাম আমার এক বন্ধু স্থানীয় ভাইয়ের কাছে । নামটার মধ্যেই এক মনকাড়া মিষ্টি গন্ধের সুবাস । এক সকালে রওনা দিলাম সেই ম্যাপের বাইরে গ্রামে । এসে দেখি উল্টো । সাদা ক্ষীর নেই তবে চারিদিকে সবুজের সমারোহ আর সাথে হরেক পাখপাখালির কলরব । পাখির ডাকে ঘুম ভাঙে এমন জিনিস বর্তমানে বিরল ।
উঠলাম অশতিপর গোকুল সামন্তের বাড়ী । প্রথমে ভেবেছিলাম বৃদ্ধ নরম মনের কিন্তু যখন চশমার ফাঁক দিয়ে আমাকে আচ্ছা করে জরিপ করতে শুরু করলেন তখন ভ্রমটা ভাঙল । শেষে আমার সকল প্রশ্নের উত্তরে আপাত সন্তুষ্ট হয়ে বিরস মুখে থাকার জায়গা দেখিয়ে বৃদ্ধ হাঁটা লাগালেন । আমি লেখক মানুষ , এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন বহুবার হয়েছি ।
২
ভোরবেলায় ওঠা আমার বহুকালের অভ্যাস । ফুরফুরে হাওয়ায় হাঁটতে বেরবো ঠিক তখনই গোকুল বুড়ো এক কাপ চা নিয়ে হাজির । ঠোঁটের কোণায় হাল্কা হাসির রেশ । বললেন , “ কিছু মনে করবেন না কালকের জন্য । আজকাল মানুষ আর চিনতে পারি না ।” বুঝলাম , মানুষের মনে অনেক কথা জমাট পাথরের মত চাপা থাকে । ফিরতে বেশ বেলা হল । গতকাল বাড়ীটাকে ভাল করে দেখা হয় নি ভাল করে । সকালের আলোতে দেখলাম আমি যে ঘড়ে আছি তার ঠিক বাঁ পাশে কাঁচা গলি চলে গেছে । একটু এগোতেই কানে এল পাখীর চিচিরমিচির শব্দ । যা দেখলাম তাতে হতভম্ব । বুড়োর কাঁধে , পিঠে নানা পাখি বসে আছে । একটাও সুস্থ না । কারো পায়ে কাপড়ের পট্টি , কারো ডানা ভাঙা । গোকুল সামন্ত পরম স্নেহে হাতে ধরে ছাতুর গুলি খাওয়াচ্ছে । ওদের সাথে বাচ্চাদের মত কথা বলছে । আমি কাকে দেখছি ! কোথায় সেই খিটখিটে মানুষটা ! এগিয়ে গেলাম হাসিমুখে । ফল হল উল্টো । যাচ্ছেতাই ভাবে চীৎকার করে আমাকে প্রায় মারতে আসে আর কী! কোনমতে বেরিয়ে এসে ভাবলাম আর নয় ! কাল থেকে অনেক অপমান সয়েছি ।
৩
পরদিন সকাল হতেই ষ্টেশনের উদ্দেশ্যে পা বাড়ালাম । ছোট্ট করে “আসি” বলতেই বুড়োকে দেখলাম অবাক চোখে আমার দিকে চেয়ে আছে । রাস্তার পাশে চায়ের দোকান । গলা ভেজাবো বলে বসলাম । পাশের এক ছোকরা গোছের ছেলে আমার দিকে চেয়ে প্রশ্ন করল , “ দাদাকে নতুন দেখছি ।” মাথা নেড়ে সম্মতি প্রকাশ করলাম । ছেলেটি আবার বলল , “ কোথায় গেছিলেন ?” উত্তরে গোকুল সামন্তের কথা বলতেই ছেলেটি অবাক গলায় বলল , “ ও আপনিও পাখী বুড়োর মত ?” কথাটার মানে বুঝতে না পারলাম না বুঝে ছেলেটি আবার বলল , “ আপনার হাতে সময় আছে , যাবেন আমার সাথে ?”
নীরবেই এগিয়ে গেলাম বেশ খানিকটা । গ্রামটার উত্তর দিকে গাছে ঘেরা বিশাল জলাশয় । মাঝে একটা সবুজ অংশ । টলটল করছে জল । ছেলেটি এবার বলল , “ কিছু বছর আগে এমনটা ছিল না । দীঘিটা প্রায় বেদখল হয়ে গেছিল , ফ্ল্যাট হবে বলে । এবার শীতকালে এসে দেখবেন কত পাখী এসেছে ।”
আমি জিজ্ঞাসা করলাম , “ কেন আগে আসত না ?” “ আসত , তবে পিকনিক করতে এসে কত লোক পাখী মারতো । আমাদের গোকুল বুড়োর সাথে ওইসব লোকদের কম ঝামেলা হয় নি ” ছেলেটি হাল্কা স্বরে উত্তর দিল ।
খানিক দম নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলে , “ বুড়োর মাথাটা গেছে । আর যাবে নাই বা কেন বলুন ? প্রমোটারের গুণ্ডা একদিন গোকুল বুড়োর মাথায় মারল রড দিয়ে । তবে গোকুল সামন্ত ছাড়বার পাত্র নয় , নিজের জমি জায়গা বিক্রি করে মামলা লড়ে দিঘীর জমি বাঁচায় ।”
আমি বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকলাম । ছেলেটি হেঁসে বলে , “ দাদা , বুড়ো দিব্যি আছে । মাঝে মধ্যে খেপে যায় ঠিকই কিন্তু মাথাটা গেলেও প্রকৃতির কাছে আমাদের থেকে অনেক সুস্থ । ওনার মত পাগল আছে বলেই প্রকৃতি সাথে আমরাও বেঁচে আছি ।”
গোকুল সামন্তের কাছে আমি আর যাই নি । ট্রেনে যেতে যেতে দেখলাম একদল পাখী ডানা মেলে উড়ছে । হয়তো বুড়োর সন্ধানে বেরিয়েছে ।।
=======================================================================================
Be the first to comment