বাজে মধুর সুরে

Spread the love

তপন মল্লিক চৌধুরী

একজন ভারতীয় বাঙালি সঙ্গীতজ্ঞ যিনি সেতারে কিংবদন্তিতুল্য, তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব বিশ্বব্যাপী সুপরিচিত। ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের মাইহার ঘরানার স্রষ্টা আলাউদ্দীন খান সাহেবের শিষ্য রবি শঙ্কর ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ঐতিহ্য এবং ভারতীয় সঙ্গীতকে গত শতাব্দীর ষাট-এর দশকে পাশ্চাত্য বিশ্বের কাছে প্রথম তুলে ধরেন। তাঁর সাঙ্গীতিক কর্মজীবনের পরিব্যাপ্তিও ছয় দশক জুড়ে।

১৯৩৮ সালে, আঠারো বছর বয়সে রবিশঙ্কর বড় ভাই উদয়শংকরের নাচের দল ছেড়ে মাইহারে ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের আচার্য আলাউদ্দীন খান সাহেবের কাছে সেতারের দীক্ষা নিতে শুরু করেন। দীক্ষাকালে তিনি আচার্যের পুত্র সরোদের অমর শিল্পী ওস্তাদ আলী আকবর খানের সংস্পর্শে আসেন। তাঁরা পরবর্তীতে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সেতার-সরোদের যুগলবন্দী বাজিয়েছেন। গুরুগৃহে রবিশংকর দীর্ঘ সাত বছর সেতারে সঙ্গীত শিক্ষা নেন। এই শিক্ষাকাল পরিব্যাপ্ত ছিল ১৯৩৮ হতে ১৯৪৪ সাল পর্যন্ত।

১৯৩৯ সালে আহমেদাবাদে  রবিশঙ্করের সর্বপ্রথম একক সেতার পরিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। শুরু থেকে পণ্ডিত রবিশঙ্কর নিজেকে তুলে ধরেছেন একজন বৈশ্বিক সঙ্গীতজ্ঞ, সঙ্গীত স্রষ্টা, পারফর্মার এবং ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের মেধাবী দূত হিসেবে। ১৯৪৫ সালের মধ্যে রবিশঙ্কর সেতার বাদক হিসেবে ভারতীয় ঐতিহ্যবাহী শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের একজন শিল্পী হিসেবে স্বীকৃতি পেয়ে যান।

 

এই সময়ে রবিশঙ্কর তাঁর সাঙ্গীতিক সৃজনশীলতার অন্যান্য শাখায়ও পদচারণা শুরু করেন। তিনি সুর সৃষ্টি, ব্যালের জন্য সঙ্গীত রচনা এবং চলচ্চিত্রের সঙ্গীত পরিচালনা করেন। ‘ধরতি কি লাল’ এবং ‘নীচা নগর’ চলচ্চিত্র দুটির সঙ্গীত রচনা ও সুরারোপ করেন। কবি ইকবালের সারে জাঁহাসে আচ্ছা কবিতাকে অমর সুরে সুরারোপিত করে ভারতীয় জাতীয় সঙ্গীতের পর সবচেয়ে জনপ্রিয় গান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন।

১৯৪৯ সালে রবিশঙ্কর দিল্লীতে অল ইন্ডিয়া রেডিওর সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে যোগ দেন। একই সময়ে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন বৈদ্য বৃন্দ চেম্বার অর্কেষ্ট্রা । ১৯৫০ হতে ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত রবিশঙ্কর অত্যন্ত নিবিড়ভাবে সঙ্গীত সৃষ্টিতে ব্যাপৃত ছিলেন। এ সময়ে তাঁর উল্লেখযোগ্য সৃষ্টি হলো সত্যজিৎ রায়ের অপু ত্রয়ী (পথের পাঁচালী, অপরাজিত ও অপুর সংসার) চলচ্চিত্রের সঙ্গীত পরিচালনা। পরবর্তীতে তিনি চাপাকোয়া (১৯৬৬) চার্লি (১৯৬৮) ও গান্ধী (১৯৮২) সহ আরো চলচ্চিত্রের সঙ্গীত পরিচালনা করেছেন। ১৯৬২ সালে পণ্ডিত রবিশঙ্কর কিন্নর স্কুল অব মিউজিক, বম্বে এবং ১৯৬৭ সালে কিন্নর স্কুল অব মিউজিক, লস এন্‌জেলেস স্থাপন করেন।

রবিশঙ্করের সঙ্গীত ব্যক্তিত্বের দুটি ভিন্ন দিক; উচ্চাঙ্গ সেতার শিল্পী হিসেবে তিনি সব সময়ই ঐতিহ্যমুখী ও শুদ্ধতাবাদী  কিন্তু সঙ্গীত রচয়িতা হিসেবে তিনি সব সময়ই নিজের সীমাকে ছাড়িয়ে যেতে চেয়েছেন। ১৯৬৬ সালে বিটলস্-এর জর্জ হ্যারিসনের সাথে যোগাযোগের আগে থেকেই তিনি সঙ্গীতের বিভিন্ন ধারা ও তার প্রভাব নিয়ে কাজ শুরু করেছিলেন। পরবর্তীতে তিনি জ্যাজ সঙ্গীত, পাশ্চাত্য শাস্ত্রীয় সঙ্গীত ও লোকসঙ্গীত নিয়ে কাজ করেন।

১৯৫৪ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নে অনুষ্ঠানের মাধ্যমে রবিশঙ্কর ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের বাহক হিসেবে তাঁর সেতারবাদনকে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে প্রথম তুলে ধরেন। এরপর ১৯৫৬ সালে তিনি ইউরোপ ও আমেরিকায় সঙ্গীত পরিবেশন করেন। ওই সময় তিনি এডিনবার্গ ফেস্টিভালে এবং রয়াল ফেস্টিভাল হলেও সেতার পরিবেশন করেন।

১৯৬৫ সালে বিটলস্-এর জর্জ হ্যারিসন সেতারের সুর নিয়ে গবেষণা শুরু করলে রবিশঙ্করের সাথে তাঁর যোগাযোগ তৈরি হয় এবং পরবর্তীতে তা বন্ধুত্বে পরিণত হয়। এই বন্ধুত্ব রবিশংকরকে অতিদ্রুত আন্তর্জাতিক সঙ্গীত পরিমন্ডলে নিজস্ব অবস্থান সৃষ্টিতে সাহায্য করে। রবিশংকর পপ সঙ্গীতের গুরু জর্জ হ্যারিসনের মেন্টর হিসেবে পাশ্চাত্য সঙ্গীত জগতে পরিচিত হন। এর ফলে রবিশঙ্করকে এমন সব সঙ্গীত উৎসবে সঙ্গীত পরিবেশনের আমন্ত্রণ জানানো হয় যা শাস্ত্রীয় সঙ্গীত পরিবেশনের উপযোগী পরিবেশ নয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো মন্টেরি পপ ফেস্টিভ্যাল, মন্টেরি, ক্যালিফোর্নিয়া; এ অনুষ্ঠানে ওস্তাদ আল্লারাখা তবলায় সঙ্গত করেছিলেন। ১৯৬৭ সালে তাঁর আমেরিকার অনুষ্ঠানমালা তাঁকে এক অভাবনীয় সফলতা এনে দিয়েছিল। অনুষ্ঠানের পর তাঁকে বিভিন্ন কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতা দেবার আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। এছাড়াও ১৯৬৯ সালে তিনি উডস্টক ফেস্টিভ্যালে সঙ্গীত পরিবেশন করেছিলেন।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের স্বপক্ষে প্রচার ও মানবিক সহায়তার জন্য জর্জ হ্যারিসনের উদ্যোগে নিউ ইয়র্কের ম্যাডিসন স্কোয়ার গার্ডেনে আয়োজিত কনসার্ট ফর বাংলাদেশ অনুষ্ঠানে সেতার বাজিয়েছিলেন। পণ্ডিত রবিশংকরই মূলতঃ এই অনুষ্ঠানের জন্য জর্জ হ্যারিসনকে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে কনসার্ট ফর বাংলাদেশ একটি অবিস্মরণীয় ঘটনা। জর্জ হ্যারিসনের ১৯৭৪ সালের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অনুষ্ঠানসূচিতে পণ্ডিত রবিশঙ্কর ও তাঁর সঙ্গীরা উদ্বোধনী অনুয়াহঠানে সঙ্গীত পরিবেশন করেছিলেন।

পণ্ডিত রবিশঙ্করের অমর কীর্তি পাশ্চাত্য ও প্রতীচ্যের সঙ্গীতের মিলন। পাশ্চাত্য সঙ্গীতের বিখ্যাত বেহালাবাদক ইহুদী মেনুহিনের সঙ্গে সেতার-বেহালার কম্পোজিশন তাঁর এক অমর সৃষ্টি যা তাঁকে আন্তর্জাতিক সঙ্গীতের বিশেষ আসনে বসিয়েছে। তাঁর আরো একটি বিখ্যাত সঙ্গীত কম্পোজিশন বিখ্যাত বাঁশীবাদক জ্যঁ পিয়েরে রামপাল, জাপানী বাঁশীর সাকুহাচি গুরু হোসান ইয়ামামাটো এবং কোটো (ঐতিহ্যবাহী জাপানী তারযন্ত্র) গুরু মুসুমি মিয়াশিতার জন্য। ১৯৯০ সালে বিখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ ফিলিপ গ্রাসের সঙ্গে যৌথ প্রযোজনা প্যাসেজেস তাঁর একটি উল্লেখযোগ্য সৃষ্টি। ২০০৪ সালে পণ্ডিত রবিশংকর ফিলিপ গ্রাসের ওরিয়ন প্রযোজনার সেতার অংশের সঙ্গীত রচনা করেন।

ফেসবুক থেকে পাওয়া পণ্ডিত রবিশঙ্করের একটি দুর্লভ ছবি

শনিবার বিশিষ্ট সঙ্গীতজ্ঞের জন্মদিনে রোজদিনের পক্ষ থেকে জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা।

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*