পরী

Spread the love

পায়েল ব্যানার্জীঃ

পরী ,পরী করে সমানে অস্থির হয় মা।হবে নাইবা কেন মালতির একমাত্র মেয়ে হলো পরী।অনেক সাধ করে নাম রেখেছিল পরী।পরী তখনও জন্মায়নি ,মালতি অন্তঃসত্ত্বা,হটাৎ খবর এলো পরীর বাবাকে হাসপাতালে দেওয়া হয়েছে।খবরটা শুনেই দৌড়ে গেছিলো মালতি।কিন্তু,গিয়েও লাভ হয়নি শেষবারের মতো আর দেখতে পায়নি তাকে।

রাজমিস্ত্রি ছিল পরীর বাবা ,বড় বাড়ি বানাতে গিয়ে সেখান থেকে পড়ে মারা যায় সে।তারপর থেকে মালতি একাই মানুষ করছে পরী কে।লোকের বাড়ি কাজ করে পরী আর মালতির চলে যায়।মায়ের নয়নের মনি হলো পরী।আর পরী ছাড়াতো কেউ নেইও তার এ জীবনে।
-“পরী মা ঘুমিয়ে পর ,এবার কাল সকালে উঠে আমাকে আবার কাজে যেতে হবে।
-একটা গল্প বলো মা তাহলে ঘুমিয়ে পড়বো।
– একটা রাজকন্যা ছিল।খুব আদরের ছিল সবার,একদিন একটা সাদা ঘোড়ায় এক রাজপুত্র আসে আর রাজকন্যাকে নিয়ে যায় এক সুন্দর জায়গায়,যেখানে শুধু রাজপুত্র আর রাজকন্যা……”

গল্প শুনতে শুনতেই ঘুমিয়ে পড়তো পরী।এই ভাবেই চলতো তাদের দিন।আপনজন বলতে পাড়ার কয়েকজন লোক আর মালতির ভাই আর ভাইয়ের বউ।

আজ মালতির গায়ে খুব জ্বর।কিন্তু কাজে যেতে হবে নাহলে বাবুদের বাড়িতে সবাই খুব চেঁচামেচি করে,আবার টাকা কেটে নেবার ভয় দেখায়।
“মা আজ আর যেও না কাজে।
না রে মা যেতেই হবে না গেলে যে….”

মেয়ের কাছে নিজের অপমানের কথা চেপে যায় মালতি,পাছে মেয়ে কষ্ট পায়।এই ভাবে তিনদিন জ্বরে কেটে যায় ,মালতির জ্বর আর ছাড়েনা তবুও কাজে যাচ্ছে সে।কিন্তু আজ আর সে উঠতেই পারছেনা বিছানা থেকে।মালতি পরীকে বলে তার মামার বাড়িতে খবর পাঠাতে।পরী পাশের বাড়ির এক কাকুকে বলে তার মামাকে খবর দেবার জন্য,মাকে ছেড়ে সে যেতে পারবেনা এই অবস্থায় তাই তাকে বলে খবর দেবার জন্য।মামার বাড়ি থেকে মামা মামী সবাই আসে,খবর পেয়ে।সেই রাত্রেই মারা যায় মালতি।মারা যাবার আগে সে তার ভাইকে বলে
– “ভাই আমার জমানো সামান্য কিছু টাকা আছে সেই গুলো নিস আর পরী কে দেখিস ও যে বড় আদরের মেয়ে আমার….” বলেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে মালতি।

মালতির সমস্ত কাজ সম্পন্ন করে পরী,মামার সাথে চলে যায় তাদের বাড়ি।সেখানে মামা মামী ভাই বোন সবার মধ্যেই বড় হতে থাকে পরী।এখন সে একাই ঘুমিয়ে পরে।তাকে আর রাজপুত্রের গল্প শোনানোর কেউ নেই।মামা মামী নিজের সন্তানদের নিয়েই বেশী ব্যাস্ত থাকে,তবে পরীকে তারা অবহেলা করে না,কিন্তু এই পৃথিবীতে মা বাবার জায়গা তো নেওয়া মুখের কথা নয়।পরীর মালতির কথা খুব মনে পড়ে আর চোখের জল ফেলে।মামা মামীও বলে
– “একদিন দেখবি পরী কোনো রাজপুত্র এসে তোকে নিয়ে যাবে এক খোলা আকাশের নিচে যেখানে তুই সব ভুলে যাবে কোনো দুঃখ থাকবে না তোর”।

ধীরে ধীরে পরী যৌবনে পা রাখলো।তার জীবনে এলো নয়ন নামের একটি ছেলে।নয়ন শহর থেকে এসেছে তার এক বন্ধুর বাড়ীতে ঘুরতে।কলেজ যাবার পথে পরী কে দেখেই নয়নের ভালো লেগে যায়।কোথাও না কোথাও পরীর ও ভালো লাগে নয়নকে।পরী মায়ের বলা সেই রাজপুত্রের কথা ভাবতে থাকে।

নয়ন পরী কে বিয়ের প্রস্তাব দেয়।রীতিমতো মামা মামীর অনুমতি নিয়ে নয়ন আর পরীর বিয়ে হয় মন্দিরে।বিয়ের পরই পরী নয়নের হাত ধরে পাড়ি দেয় শহরের উদ্যেশ্যে।মায়ের বলা রাজপুত্রের গল্প যেন সত্যি হতে দেখে পরী চোখের সামনে।

শহরে একটা ঘর ভাড়া নিয়ে থাকতে শুরু করে তারা।
“কি গো কবে নিয়ে যাবে আমাকে তোমার নিজের বাড়ি বাবা মায়ের কাছে।
যাবো যাবো আর কিছু দিন অপেক্ষা করো তারপর যাবো।”
সকালে নয়ন কাজে বেরিয়ে গেলে সারাদিন রান্না আর ঘরের কাজেই সময় যায় পরীর।এই রকম চলতে চলতে একদিন হঠাৎ নয়ন বলে
– “চলো আমরা বেড়াতে যাবো ।
– “সত্যি !কোথায় যাবো আমরা?”
এক মুহুর্তে পরী চোখের সামনে যেন সব স্বপ্ন সত্যি হতে দেখে।
কোনোদিন সে কোথাও যায়নি।যা ওই গ্রামে ছিল আর নয়নের সাথে শহরে এসেছে।মায়ের বলা গল্প যেন সত্যি হতে চলেছে।ভেবেই কি ভালো যে লাগছে পরীর।নিজের খুশি ধরে রাখতে পারছেনা সে।
– “কোথায় যাবো গো বলো না বলো না।
– চলো না।
– কিছু জামা কাপড় নিয়ে নিও।
– হ্যাঁ।আমরা কোথায় যাচ্ছি বললে না তো।
– আরে চলই না।
– এটা কোথায় গো এখানে গলির মধ্যে আমরা কোথায় যাচ্ছি তোমার বাড়ি?
– আরে চলই না।আমার ওপর বিশ্বাস নেই নাকি।
– না তা নয়….
– এই যে এসেগেছি।

– দেখো আজ থেকে আমরা এখানেই থাকবো।
– এখানে?কিন্তু এখানে এত লোকজন তো একসাথে থাকে আর তাদের পোশাক গুলো দেখো……
– তাতে কি সবাই সবার মতো থাকে।তুমি একটু বসো আমি আসছি”।
– কোথায় যাচ্চ, আমার ভয় লাগছে।
– আরে ভয়ের কিছু নেই, বসো না আসছি।

আসছি বলে সেই যে গেল নয়ন আজও আর ফিরে এলোনা আর।
নয়নের চোখ দিয়ে পৃথিবী দেখতে চেয়েছিল পরী।কিন্তু তা আর হলো না পরীর।নয়ন পরীকে বিক্রি করে দেয়।নয়নকে পেয়ে সে ভেবেছিল সাদা ঘোড়ায় করে আসা রাজপুত্র যে তাকে খোলা আকাশের নীচে নিয়ে যাবে কিন্তু ঠেলে দিলো এক অন্ধকারময় জগতে।এখন সবাই আসে কেউ সাদা, কেউ কালো ,ঘোড়া করে কেউ বা এমনি ,কিন্তু কেউ পরী কে খোলা আকাশের তলায় নিয়ে যেতে আসে না ,আসে তার শরীর কিনতে।

খাঁচায় বসে ছটপট করতে থাকে পরী যদি কেউ তাকে মুক্ত করে দেয় কিন্তু তেমন কেউ আসে না বরং আসে তাকে এক খাঁচা থেকে আর এক খাঁচায় বন্দী করতে।

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*