কৃষ্ণকলি
মেয়েদের আবার পড়াশোনা? এই ভূগোল নিয়ে পড়ে কি হবে? প্র্যাকটিক্যাল-এর হাজারো ফিরিস্তি। এই কেনো ওই কেনো। পারবো না পরিস্কার বলে দিচ্ছি। এর ওপর আবার বিয়ে দেওয়ার খরচ। চোখের জলে পাখীর আঁকা ম্যাপে তখন ভারত শ্রীলঙ্কা একাকার। কোনরকমে চোখ মুছে বেরিয়ে যায়। ডোডো, তাতাইকে পড়ানো আছে। ক্লাস নাইনের যমজ দুই ভাইকে পড়ায় পাখি। টিউশনি করে অনেকটা পড়ার খরচ ওঠে। যদিও পাখির বাবা সরকারি চাকরি করেন শুধু নয় উচ্চপদে কর্মরত। কিন্তু তিন কন্যা হওয়ায় তিতিবিরক্ত। তিন মেয়ে রাখী,আঁখির পর পাখি।
বড় আদরের মেয়ে রত্না দেবীর। পাড়ার সকলে বলে রত্নগর্ভা তিনি। তিন মেয়েই মিষ্টি,শান্ত স্বভাবের। তবে পাখি যেন রূপে লক্ষ্মী গুনে সরস্বতী। কিন্তু সুজন বাবুর যত রাগ ঐ পাখির ওপর। পরপর দুই মেয়ের পর তৃতীয় জন ও মেয়ে! তাও আবার উচ্চশিক্ষা! না পাখির আর পড়াশুনা করা হয়নি। নার্সিং এর ট্রেনিং নিয়ে কোচবিহারে চাকরি পায় সে। ওই সময় আলাপ শুভম এর সঙ্গে। বাবার মতের বিরুদ্ধেই পাখি মুখার্জির সঙ্গে বিয়ে হয় ডাক্তার শুভম ঘড়ুই এর। অসবর্ণ বিবাহ। আর কোনোদিন মুখ দেখবেন না মেয়ের, বলে দেন সুজন বাবু। আঁখি,রাখির বিয়ে দিয়েছেন সুজনবাবু। এরপর কেটে গেছে প্রায় কুড়ি বছর। পাখি ও শুভম এর সুখের সংসারে এসেছে ডানা ও পেখম। ওদের দুই মেয়ে। শুভম, পাখি সিঙ্গাপুরে সেটলড্। ডানা,পেখম ও ডাক্তারি পড়ছে সেখানে। রত্নাদেবী গত হয়েছেন প্রায় দশ বছর। মা এর মৃতদেহ ছোঁয়ার অধিকার পায়নি পাখি। সুখের মাঝেও একটা কাঁটা খচখচ করে।
যাইহোক সেদিন রবিবার। পরের দিন থেকে শুরু হয়ে যাবে রুটিন ব্যস্ততা। একটু তাড়াতাড়িই বিছানায় গিয়েছিল পাখি। হঠাৎই ভোর চারটে নাগাদ মোবাইল বেজে উঠল। কলকাতার ফোন। আননোন নাম্বার। কলকাতায় এখন রাত দেড়টা। ফোন করেছে আঁখি। বাবার সেরিব্রাল অ্যাটাক। ঢাকুরিয়া আমরিতে ভর্তি। ফোনটা রেখেই শুভমকে ডেকে তোলে। পরের দিনের ফ্লাইটে কলকাতা আসে দুজনে। সুজনবাবু তখন জীবন মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন।
সুজনবাবু প্রাণে বেঁচে যান। কিন্তু শরীরের ডানদিক অবশ হয়ে যায়। একমাস কলকাতায় থেকে সবকিছু সামলায় পাখি। আজ সুজনবাবুর হাসপাতাল থেকে রিলিজ হওয়ার দিন। তিন মেয়েই এসেছে হাসপাতালে। কিন্তু কোথায় যাবেন সুজন বাবু? রাখীর একান্নবর্তী পরিবার। এক্সট্রা ঘর নেই। আঁখি তো স্পষ্ট বলে দিলো তার ছেলের পরীক্ষা, সুতরাং এখন বাবাকে রাখা সম্ভব নয়। অব্যক্ত এক যন্ত্রণা তখন সুজন বাবুর মুখে। আস্তে আস্তে পায়ে হাত দেয় পাখি। বাবা আমাকে কি ক্ষমা করতে পারবেনা? মনে হলো যেন সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়লেন সুজন বাবু। পাখিকে আর পায় কে? পরের দিন বাবাকে নিয়ে সোজা সিঙ্গাপুর। তখন আষাঢ় মাস, ভরা বর্ষা। ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠছেন সুজন বাবু। পুজো এলো। প্রবাসে পুজোয় পেখম ও ডানায় ভর দিয়ে সামনে ঠাকুর ও দেখলেন। এলো বিজয়া। পাখি ও শুভম বাবাকে প্রণাম করতে দুচোখ বেয়ে জল এলো সুজন বাবুর।
Be the first to comment