১৯৪৫ সালের ১৩ নভেম্বর। বাংলাদেশে জন্মগ্রহণ করেন প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সি । পিতা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ দাশমুন্সি, মা রেণুকণা দেবী। উত্তর দিনাজপুর জেলার রায়গঞ্জ কলেজ থেকে স্নাতক। পরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ (MA) এবং এলএলবি (LLB) ডিগ্রিতে সসম্মানে উত্তীর্ণ হন। কলকাতা হাইকোর্টের আইনজীবী হিসেবে কর্মজীবন শুরু। তারপরে দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবন। ১৯৯৪ সালে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন দীপা দাশমুন্সির সঙ্গে। নাট্য জগতের মেয়ে দীপা পরে রাজনীতিতেও আসেন। প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সির পুত্র সন্তানের নাম প্রিয়দীপ দাশমুন্সি ওরফে মিছিল। বাবা সাধ করেই ছেলের নাম দিয়েছিলেন মিছিল।
ছাত্রকাল থেকেই সক্রিয় রাজনীতিতে যোগদান করেন । নির্বাচিত হন ছাত্র পরিষদের সভাপতি হিসাবে। যুব কংগ্রেস সভাপতি হওয়ার পাশাপাশি তিনি পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতির গুরু দায়িত্বও পালন করেন। ১৯৭১ সালে প্রথম সংসদীয় রাজনীতিতে প্রবেশ করেন প্রিয়রঞ্জন। লোকসভায় প্রথমবার নির্বাচিত হন দক্ষিণ কলকাতা কেন্দ্র থেকে। দ্বিতীয়বার ১৯৮৪ সালে নির্বাচিত হন হাওড়া কেন্দ্র থেকে। মাঝে দুবার হার। ১৯৯৬ সালে হাওড়া থেকে আবারও জয়ী হন। আর ১৯৯৯ সালে রায়গঞ্জ থেকে নির্বাচিত হন। পরেও এই কেন্দ্রে থেকে ২০০৪ সালে নির্বাচিত হন তিনি। বাংলার নেতাদের মধ্যে রাজীব গান্ধীর অন্যতম ঘনিষ্ঠ ও বিশ্বস্ত প্রতিনিধি ছিলেন প্রিয়রঞ্জন। ১৯৮৫ সালে রাজীব মন্ত্রীসভায় প্রথমবার তিনি ভারতের বাণিজ্য দপ্তরের রাষ্ট্রমন্ত্রী হন। এরপরে ঘটেছে অনেক রাজনৈতিক পট পরিবর্তন। কংগ্রেসের বিশিষ্ট নেতা হিসাবে বহু গুরু দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। লোকসভায় কংগ্রেসের চিফ হুইপ হয়ে দক্ষতার পরিচয় দিয়েছিলেন। পরে কংগ্রেস মন্ত্রীসভায় জলসম্পদ মন্ত্রী হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। তবে ইউপিএ সরকারের আমলে সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী এবং তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী হিসাবে তাঁর অবদান উল্লেখযোগ্য।
শুধু রাজনীতিই নয়, খেলাধুলোতেও তাঁর অবদান ছিল অপরিসীম। অল ইন্ডিয়া ফুটবল ফেডারেশনের সভাপতি পদে ছিলেন প্রায় ২০ বছর। প্রথম ভারতীয় হিসেবে ২০০৬ ফিফা বিশ্বকাপের ম্যাচ কমিশনার হন প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সি৷ অস্ট্রেলিয়া ও ক্রোয়েশিয়া ম্যাচে কমিশনারের দায়িত্ব পালন করে নজির গড়েন তিনি৷ শুধু তাই নয় জাতীয় ফুটবল (বর্তমানে আইলিগ) লিগ শুরু হয়েছিল তাঁর হাত ধরেই। তিনি ছিলেন সুবক্তা- বাগ্মী। বাংলার রাজনীতির সমস্ত খুঁটিনাটি তাঁর হাতের তালুর মতো চেনা৷ দেশের রাজনীতিতে তিনি ছিলেন গান্ধি পরিবারের খুবই কাছের৷ দেশীয় রাজনীতির সঙ্গে বাংলায় কংগ্রেসে তিনিই ছিলেন প্রধান মুখ৷ তাঁর হাত ধরে বাংলার রাজনীতির ময়দানে উঠে এসেছেন বহু নেতারা৷ সাংসদ ও মন্ত্রিত্বের দায়িত্ব নিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন তাঁর রাজনৈতিক বিচক্ষণতা।
সবকিছু ঠিকঠাকই চলছিল। কিন্তু হঠাৎ তাল কাটলো ২০০৮ সালের জুলাই মাসে। কালিয়াগঞ্জের শ্রীকলোনির বাড়িতে হঠাৎই অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। কলকাতার আ্যাপোলো হাসপাতালে চিকিৎসা হয়। অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টির পর সুস্থও হয়ে যান তিনি। আবার নিজের রাজনৈতিক কর্মকান্ডের মধ্যে ফিরে যান। কিন্তু আবার কিছুদিন বাদে পুজোর পরে দিল্লিতে অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। দিনটি ছিল ১২ই অক্টোবর, ২০০৮। দিল্লির এইমস (AIIMS) হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। কিন্তু মস্তিষ্কে অতিমাত্রায় রক্তক্ষরণের ফলে তিনি কোমায় চলে যান। এরপর শারীরিক অবস্থার আর বিশেষ কোনও উন্নতি হয়নি। কিছুদিন পর এইমস (AIIMS) কর্তৃপক্ষ তাঁকে বাড়ি নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিলেও দলের পক্ষ থেকে তাঁকে দিল্লির ইন্দ্রপ্রস্থ অ্যাপোলো (Apollo) হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হয়।
প্রিয়দাকে আবার আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে বিভিন্ন ভাবে চেষ্টা করা হয়েছিল। হাসপাতালের কেবিনেই তাঁর প্রিয় ফুটবল ম্যাচ তাঁকে দেখানো হত। উত্তম- সুচিত্রার সিনেমা ভালোবাসতেন বলে তাও দেখানো হত। শোনানো হত তাঁর প্রিয় রবীন্দ্র সঙ্গীত। তাঁর আদরের একমাত্র সন্তান মিছিল তখন ছোট। বারবার আসত বাবাকে দেখতে। আসতেন দলীয় সতীর্থ থেকে শুরু করে বিভিন্ন দলের শুভানুধ্যায়ীরা। কিন্তু সব প্রচেষ্টাই ব্যর্থ হয়। প্রিয়দা কোনও কিছুতেই সাড়া দেননি। এইভাবেই চলল দীর্ঘ ৯ বছর। গত ১ মাস ধরে শরীর ক্রমশ খারাপ হতে থাকে। তাঁর ফুসফুসেও ধরা পড়ে ইনফেকশন। যার জেরেই শারীরিক অবস্থার আরও অবনতি হতে থাকে। আর সব লড়াইয়ের অবসান ঘটিয়ে সোমবার বেলা ১২টা ১০ নাগাদ তাঁর মৃত্যু হল সকলের প্রিয় প্রিয়দার। চলে গেলেন তিনি কিন্তু রেখে গেলেন রাজনীতি, ক্রীড়া প্রভৃতি নানা ক্ষেত্রে তাঁর অসামান্য কৃতিত্বের বহু নিদর্শণ। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭২ বছর।
তাঁর মৃত্যুতে শোকজ্ঞাপণ করেছেন দেশ ও রাজ্যের প্রায় সমস্ত দল। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী থেকে শুরু করে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি, কংগ্রেস নেত্রী সোনিয়া গান্ধী সবাই ট্যুইটারে শোকজ্ঞাপণ করেন। রোজদিনের তরফ থেকেও প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সিকে জানাই শ্রদ্ধা।
Be the first to comment