
জয়দীপ মৈত্র,বালুরঘাট : বালুরঘাট বি এড কলেজের সেমিনার হলে বিশিষ্ট ইতিহাস গবেষক বঙ্গরত্ন প্রাক্তন অধ্যাপক হিমাংশু কুমার সরকার মহাশয়ের ”আত্রাই নদীর ইতিকথা” গ্রন্থ আনুষ্ঠানিক ভাবে প্রকাশিত হলো। এই মহতী অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন দক্ষিণ দিনাজপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. প্রণব ঘোষ। আজকের এই অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির আসন অলংকৃত করেন প্রাক্তন অধ্যাপক কমলেশ দাস, বিশিষ্ট আইনজীবী সুশোভন চ্যাটার্জী, কবি মৃণাল চক্রবর্তী,বঙ্গরত্ন কবি বিশ্বনাথ লাহা, বিশিষ্ট শিক্ষিকা তথা দক্ষিণ দিনাজপুর চাইল্ড ওয়েলফেয়ার কমিটির চেয়ারপার্সন মন্দিরা রায়, রথীন ঘোষ, ইতিহাস অনুসন্ধান পরিষদের সম্পাদক ড. নব কুমার দাস সহ আরও গুণীজন। এছাড়াও উপস্থিত ছিলেন স্বপন কুমার বিশ্বাস, বালুরঘাট কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ আশীষ দাস, বালুরঘাট লোকসভার প্রাক্তন সাংসদ রনেন বর্মন, বিশিষ্ট সমাজসেবী দীপক মণ্ডল সহ আরো অনেকে। অনুষ্ঠানের শুরুতে উদ্বোধনী সংগীত পরিবেশন করেন বালুরঘাট বি এড কলেজের ছাত্রছাত্রীরা। প্রদীপ প্রজ্জ্বলন করেন উপস্থিত অতিথিবৃন্দ। স্বাগত বক্তব্য রাখেন বালুরঘাট বি এড কলেজের অধ্যক্ষা ববি মোহন্ত। আত্রেয়ী নদীর উপর বিস্তারিত আলোচনা করেন ড. নব কুমার দাস সহ আরো অনেকে। সমগ্র অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন বিশিষ্ট সঞ্চালক সঞ্জয় কর্মকার। ইতিহাস অনুসন্ধান পরিষদের সহ সম্পাদক সূরজ দাশ সকল অতিথি অভ্যাগতদের ধন্যবাদ জানানোর পর আজকের বই প্রকাশ অনুষ্ঠান শেষ হয়। “আত্রাই নদীর ইতিকথা” গ্রন্থটির উপরে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করেন বিশিষ্ট ইতিহাস গবেষক হিমাংশু কুমার সরকার তাঁর এই নতুন বইটি সম্পর্কে বলেন, ‘উত্তর দিকে প্রাচীন কৌশিকী বা কোশী নদীর পূর্ববাহিনী প্রবাহ পথ এবং দক্ষিণ দিকে গঙ্গা নদীর প্রাচীন খাতের মধ্যে সংযোগ রক্ষাকারী আত্রাই তথা আত্রেয়ী নদী অতি প্রাচীন কালে অর্জন করেছিল পবিত্র নদীর মর্যাদা। অন্যান্য নদীর মতো এই আত্রাই নদীর প্রবাহ পথে পলি জমে তৈরি হয়েছে অনেক স্থলভূমি এবং কালক্রমে এই স্থলভূমি গ্রহণ করেছে গ্রামের কূপ। এতে প্রতিপন্ন হচ্ছে সুদূর অতীতে আত্রাই নদী মাঝে মাঝে এক কূল ভেঙে গড়েছে অন্য কূল। এতে নদীর গতিপথে সৃষ্টি হয়েছে কিছু কিছু বাঁক। বালুরঘাট শহরের মধ্যে এই নদীর পুরানো পরিত্যক্ত খাতের চিহ্ন দিচ্ছে তারই ইঙ্গিত। গুপ্ত শাসনকালে বা তার কাছাকাছি সময়ে শুরু হয়েছিল বৈদিক ধর্মের বিবর্তন। পৌরাণিক ধর্মের আবির্ভাবের ফলে লুপ্ত হয়েছিল অধিকাংশ বৈদিক দেবদেবীর পূজা-প্রকরণ। ঘটেছিল বৈষ্ণব ধর্ম, শৈব ধর্ম ও নানা লৌকিক ধর্মের মধ্য দিয়ে নতুন নতুন দেব-দেবীর আবির্ভাব। বালুরঘাট শহরের উত্তর পার্শ্বে ডাঙ্গা গ্রামে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এই নব ধর্ম সাধনার এক প্রকৃষ্ট কেন্দ্র। আবার পাল বংশের শাসনকালে আত্রাই নদীর স্রোতধারায় তরঙ্গায়িত হয়েছিল নানা ঐতিহাসিক ঘটনার আবর্তন। এই নদীর তীরভূমিতে স্থাপিত হয়েছিল গৌড় সাম্রাজ্যের জয়স্কন্ধাবার ও রাজধানী। তার নাম ছিল কাঞ্চনপুর এবং তার অবস্থান ছিল বালুরঘাট শহর থেকে ২৩/২৪ মাইল দক্ষিণে। আবার এই আত্রাই নদীর তীরভূমিতেই পাল সম্রাট দ্বিতীয় মহীপালের অনৈতিক কাজের বিরুদ্ধে উড্ডীন হয়েছিল বিদ্রোহের পতাকা। সেটি ছিল সামন্ত বিদ্রোহ। কিন্তু প্রচলিত ইতিহাসে বিকৃত নামে তা উল্লিখিত হয়েছে কৈবর্ত বিদ্রোহ নামে। আবার এই আত্রাই নদীর তীরভূমিতেই সংঘটিত হয়েছিল বাংলার ভাগ্য নির্ধারণের সংগ্রাম। একদিকে ছিল পাল-শক্তি। অপরদিকে ছিল সেন-শক্তি। শেষপর্যন্ত আত্রাই ও পুনর্ভবা নদীদ্বয়ের মধ্যবর্তী ভূখণ্ডে বিজয় পতাকা উড্ডীন করেছিলেন সেন রাজা লক্ষ্মণ সেন। কিন্তু ঐতিহাসিকদের অবহেলা ও উপেক্ষার পরিণতিতে আত্রাই নদীর তীরভূমির এইসব গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ইতিহাসে পায়নি উপযুক্ত স্থান। এইসব দিকের প্রতি ইতিহাসের আলো নিক্ষেপের উদ্দেশ্যেই এই ক্ষুদ্র গ্রন্থের রচনা। প্রচলিত ইতিহাসের এই ত্রুটিগুলি দূরীভূত করে আত্রাই নদীর তীরবর্তী এলাকার সভ্যতা ও সংস্কৃতির উজ্জ্বল আলোর প্রতি সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ গ্রন্থ রচনার প্রয়াস।
Be the first to comment