তরুণ গোস্বামী : বাঙালির আড্ডাপ্রিয়তা নিয়ে অন্য প্রদেশের মানুষজন বাঙালিকে তুলোধনা করে। বাঙালি আড্ডা মারতে জানে, কাজ করতে জানে না—এই কথা প্রায়ই শুনতে হয়। আসলে ওরা বোঝেন না আড্ডা আর গপসাপ এক নয়। গপসাপ অধিকাংশ ক্ষেত্রে পরনিন্দা বা অন্যের বিষয় কথা বলা, ইংরেজিতে যাকে বলে গসিপ। আড্ডা আর গসিপ এক নয়। আড্ডার চমৎকার সংজ্ঞা দিয়েছেন বার্টেন্ড রাসেল : : “Two or three people usually like minded discussing anything under the sun and totally indifferent to time cause and effect.”. বিশ্বচরাচর কোন খাতে বইছে সে বিষয়ে প্রকৃত আড্ডাবাজরা উদাসীন, তারা তখন ব্যস্ত গান, সাহিত্য এবং সিনেমা নিয়ে নানা আলোচনাতে ডুবে যেতে।
দুর্গাপুজোর দিন আড্ডা নিয়ে অনেক মজার মজার কাহিনি আছে। নির্মল চন্দ্র-র বাড়িতে পুজো হচ্ছে। অতিথি, অভ্যাগতরা এসেছেন। এঁদের মধ্যে দুই রসিক বাঙালিও উপস্থিত। রসরাজ অমৃতলাল বসু আর দাদাঠাকুর। অমৃতলাল দাদাঠাকুরকে বলছেন, ওহে ছোকরা তোমার তো চারিদিকে কত নামডাক, তা তুমি নাকি মুখে মুখে ছড়া কাটতে পারো, তা এখন মা দুর্গাকে নিয়ে ছড়া কাটো তো দেখি। দাদাঠাকুর বললেন, দেখি চেষ্টা করে। এই বলে গান ধরেছেন, দুটি মনের কথা বলি জগদম্বে, বল দেখি মা দীনের দুঃখ কোন কালে বা কমবে। সবাই হাসিতে ফেটে পড়েছেন কিন্তু অমৃতলাল গম্ভীর, না হে ছোকরা তুমি তো বাদ দিয়ে শেষ করলে, এরপর আর মেলাতে পারবে না। দাদাঠাকুর রসিক চূড়ামণি গাইছেন—পাওনাদারের বড়োই ল্যাঠা, তাই পালিয়ে এলাম কলকাতা, যদি হত্যা করে তারা, পালিয়ে যাবো বোম্বে। অমৃতলাল বললেন, হয়ে গেল আর মিলবে না। বিনয়ের সঙ্গে দাদাঠাকুর বললেন, আপনি আশীর্বাদ করলে নিশ্চয় পারবো। এই বলে গান ধরলেন, দেশপ্রেম এর নেতা গান্ধী, বলে গেছেন পড়তে খাদি, আর যত হারামজাদা, হারামজাদি থাকে না নিতম্বে, দুটি মনের কথা বলি জগদম্বে, বল দেখি মা দীনের দুঃখ কোন কালে বা কমবে। এর মধ্যে লুচি আর ডাল এসে গেছে আর সবাই মন দিয়েছেন মধ্যাহ্নভোজনে।
পুজোর সঙ্গে গানের একটা অঙ্গাঙ্গিক যোগ ছিল। এইচএমভি থেকে শারদ অর্ঘ্য নামে একটি বই বেরোতো। তাতে থাকতো বেসিক রেকর্ড-এর গান আর গানের কথা। তখনও গ্রামোফোন অর্থাৎ ৪৫ এবং ৭৮ আরপিএম-এ রেকর্ড। পঞ্চাশের শেষে সলিল চৌধুরির পুজোর গান বেরোলো, ‘আমি ঝড়ের কাছে রেখে গেলাম আমার ঠিকানা’। হেমন্ত মুখোপাধ্যায় গায়িত গানটি অচিরেই জনপ্রিয় হয়ে উঠল। সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়-এর কণ্ঠে বিমল ঘোষ-এর কবিতা ‘উজ্জ্বল এক ঝাঁক পায়রা’—সে-ও তো পুজোতেই বেরিয়েছিল। ১৯৭০ ঘরেতে মান্না দে-র তিনটি গান পুজোতে হিট হয়—‘ললিতা গো ওকে আজ চলে যেতে বলনা’, ‘সুন্দরী দোহাই দোহাই মান কর না’ আর ‘এতো রাগ নয় গো এ যে অভিমান’। তখন রেকর্ড প্লেয়ার এসে গেছে। নতুন জামাকাপড়ের সাথে রেকর্ড কেনাটা একটা অবশ্য কর্তব্য ছিল। পুজোয় আগে নতুন বাংলা সিনেমা রিলিজ করত। আমি তিনটি সিনেমার কথা উল্লেখ করছি যেগুলির গান খুব জনপ্রিয় হয়েছিল। দেওয়া নেওয়ার ‘আমি চেয়ে চেয়ে দেখি সারাদিন, ‘মাধবী মধুপে হলো মিতালি’, ‘জীবন খাতার প্রতি পাতায় যতই লেখ হিসেব নিকেশ’, শ্যামল মিত্রর সুর মন ছুঁয়ে গেল বাঙালি শ্রোতাদের। শঙ্খবেলা-ও রিলিজ করল পুজোর আগে আর মান্না দে-র কণ্ঠে ‘কে প্রথম কাছে এসেছি’ আর ‘আমি আগন্তুক’ আর লতাজির কণ্ঠে ‘আজ মন চেয়েছে আমি হারিয়ে যাব’ প্রতি প্যাণ্ডেলে বাজছে। ‘আমি কোন পথে যে চলি’ আর ‘বাঁচাও কে আছো মোরে’ ছদ্মবেশী সিনেমা সুধীন দাশগুপ্ত-র অমর সৃষ্টি প্যাণ্ডেল-এ বাজছে আর দর্শনার্থীরা বিশাল চোং-এর নীচে দাঁড়িয়ে গান শুনছেন, তখন এই ছিল খুব পরিচিত দৃশ্য।
নবমী আর দশমী থেকে পুজো পাল্টে যেত লাগল। শুরু হয়ে গেল সেন্সরশিপ-এর পুজো। ওলট-পালট হয়ে গেল মানুষের ভাবনাচিন্তা আর জগৎ। কিন্তু সে অন্য বিষয়। পুজোর গান এখনও কানে বাজে এবং পুজো মানেই আগের মতো এখনও ডুবে যাই আড্ডায়।
Be the first to comment