নিজস্ব প্রতিবেদন,
১৩২৪ এর আষাঢ়, একটি কবি লিখছেন- ‘জীবনকে মৃত্যুর জানলা থেকে না দেখলে তাকে সত্যরূপে দেখা যায় না। মৃত্যুর আকাশে জীবনের যে বিরাট মুক্ত রূপ প্রকাশ পায়, প্রথমে তা বড়ই দুঃসহ, কিন্তু তারপর তার ঔদার্য্য মনকে আনন্দ দিতে থাকে। তখন ব্যক্তিগত জীবনের সুখ-দুঃখ অনন্তসৃষ্টির ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। জীবনকে কবি উপলব্ধি করেছেন ততোবার যতোবার তাঁর কাছের মানুষকে নিয়ে গিয়েছে মৃত্যুদূত। থেমে গিয়েছে নিকট প্রাণ, কিন্তু যা থামেনি তা হলো তাঁর লেখনীশক্তির সাবলীল ও অবিরাম সৃষ্টি। ক্লান্তিহীন সাহিত্যসাধক নন, মৃত্যুকে ছাপিয়ে বারবার তিনি হয়ে উঠেছেন জীবনীশক্তির এক মূর্ত প্রতিচ্ছবি। আর সেই বিশ্বপ্রাণের বাণী কেমন একরকম করে আপনার রক্তের মধ্যে খুঁজে পেয়েছে প্রতিটি বাঙালী।
তাই তো আমরা কবিকে খুঁজে পেয়েছি আমাদের প্রতিটি দৈনন্দিন সুখ-দুঃখ, আনন্দ-আহ্লাদ, প্রেম-বিরহের চিরাচরিত এক সাথী হিসাবে। সুখ, খুশী, আনন্দ যেমন ধ্বনিত হয় ‘ তুমি খুশী থাকো, আমার পানে চেয়ে চেয়ে খুশী থাকো’-র তালে তালে; তেমনি ঐতিহ্যের নস্ট্যালজিয়ায় বাঙালী আজও ভোলে না ‘পুরানো সেই দিনের কথা’; প্রাণের মানুষকে খুঁজে চলার ব্যাকুলতাও প্রকাশ পায় ‘আমারও পরাণ যাহা চায়’-এর মধ্য দিয়ে। আর তেমনই প্রাণের মানুষের হৃদয় উদ্বেলিত হয় যখন সে শুনতে পায় ‘ ভালোবেসে সখী নিভৃতে যতনে আমার নামটি লিখো, তোমার মনের মন্দিরে’।
স্বজন বিয়োগে যেমন আমাদের হৃদয়ে বাজতে থাকে ভরা থাক স্মৃতিসুধার সুর, তেমনই কবির কলম বারবার খুঁজতে থেকেছে সেই নিরাকার ঈশ্বরের অস্তিত্ব, যা প্রকাশ পায় ‘মাঝে মাঝে ত্ব দেখা পাই’ এর প্রতিটি স্তবকে স্তবকে। শুধু কী তাই, বাউলের সুর ও বাণী কবিকে মুগ্ধ করেছে বারবার, গ্রামবাংলার সহজ সরল দৃশ্যপটের সঙ্গে তাই বারংবার একাকার হয়ে গিয়েছেন আমাদের বাউলাঙ্গের রবিঠাকুর। আর সেকারনেই বারবার গেয়ে উঠেছেন আমাদের প্রাণপ্রিয় রবি বাউল- ‘গ্রাম ছাড়া ওই রাঙ্গা মাটির পথ’ অথবা ‘আমার প্রাণের মানুষ আছে প্রানে তাই হেরি তারে সকল খানে’।
দেশীয় ভাষার ভেদাভেদও চূর্ণ হয়েছে কবির সুরসত্ত্বায়। অকৃত্রিম সেই সমস্ত সুরমূর্চ্ছনায় আন্দোলিত হয়েছে আসমুদ্র হিমাচলের হৃদয়। বিদায় নিয়েছেন প্রায় ৭৭ বছর আগে, কিন্তু ভারতবর্ষের ইতিহাসে সর্বকালীন সমসাময়িক এমন একজন দার্শনিক রেখে গিয়েছেন তাঁর অননুকরনীয় সৃষ্টির এক মহাসমুদ্র। বাঙালী তো তাই বারবার তার রবিকবিকেই উদ্দেশ্য করে গেয়ে উঠেছে- ‘নয়ন তোমারে পায় না দেখিতে, রয়েছো নয়নে নয়নে’। দেশ, কাল, ধর্ম, জাতি, বর্ণ, সীমানা ছাড়িয়ে তাই-
‘চিরনূতনেরে দিলো ডাক পঁচিশে বৈশাখ’।
Be the first to comment