তপন মল্লিক চৌধুরী : কাঁচা অতসী ফুলের মতো গায়ের রং তাঁর। স্থানভেদে কখনো হাল্কা গোলাপী, কখনো ফিকে হলদে। কিন্তু টকটকে লাল? হ্যাঁ এমন দুর্গামূর্তিরও দেখা মেলে। শুধু রক্তবর্ণা কেন, দেখা মেলে অপরাজিতা নীল এমনকী কুচকুচে কালো দুর্গারও। গায়ের রঙের এমন বৈচিত্র দেখা যায় শ্রীচৈতন্য-র লীলাভূমি নদিয়া জেলায়। রঙের দুর্গামূর্তি ঘিরে গপ্পোকথাও আছে, তবে এসব পুজোর কোনওটাই বারোয়ারি নয়, দুশো বছরেরও বেশি পুরোনো বনেদিবাড়ির পুজো সব।
নবদ্বীপের যোগনাথতলার কুমারনাথ ভট্টাচার্যর বাড়িতে একশো সতেরো বছর ধরে হয়ে আসছে লাল দুর্গার পুজো। ভট্টাচার্য পরিবারের আদি বাড়ি ছিল অবশ্য বাংলাদেশের ঢাকা জেলার মিতরা গ্রামে। সেখানেও পুজো হত লাল দুর্গা। দেশভাগের বহু আগেই ভট্টাচার্য পরিবার মিতরা থেকে যোগনাথতলায় চলে এসেও পূর্বপুরুষদের পুজো চালিয়ে যাচ্ছেন, ধরে রেখেছেন লাল দুর্গামূর্তির ঐতিহ্য। কিন্তু দেবীমূর্তির রং লাল কেন? ঘটনাস্থল মিতরা, দেবী বন্দনার সময় গৃহকর্তা ছেলেকে পাশে বসিয়ে চণ্ডীপাঠ করছেন। ছেলে বাবার উচ্চারণে ভুল ধরলে ক্রুদ্ধ বাবা ছেলেকেই পাঠ করতে বলেন। ছেলের বিশুদ্ধ উচ্চারণ ও অপূর্ব সুরের চণ্ডীপাঠ শুনে নাকি দেবী দুর্গা এতই প্রসন্ন হন যে দক্ষিণমুখী দুর্গা পশ্চিমমুখী হয়ে যান সেই সঙ্গে তাঁর মুখের আভা আনন্দে লাল হয়ে ওঠে। এরপর থেকেই ভট্টাচার্য বাড়ির দুর্গামূর্তির গায়ের রং লাল হয়ে যায়। নদিয়ার যোগনাথতলার ভট্টাচার্য বাড়ি ছাড়াও লাল দুর্গামূর্তি পুজো হয় কৃষ্ণনগরের নেদেরপাড়ায় চক্রবর্তী পরিবারে। এদের আদি বাড়ি ছিল কৃষ্ণনগর শহরের নগেন্দ্রনগরে। সেখানেই লাল দুর্গামূর্তির পুজো শুরু হয়েছিল। সেই ঐতিহ্য বজায় রেখেছে নেদেপাড়ার বংশধররা। প্রসঙ্গত, রক্তবর্ণা দুর্গামূর্তি, স্বতন্ত্র হলেও সবথেকে জনপ্রিয় এবং প্রাচীন পুজো হল কোচবিহারের বড়দেবী বাড়ি ও জলপাইগুড়ি বৈকণ্ঠপুর রাজবাড়ির।
কৃষ্ণনগর নাজিরাপাড়ায় চট্টোপাধ্যায় বাড়ির পুজোর দুর্গা-মূর্তি আবার অপরাজিতা নীল। শরিকি দ্বন্দ্বে বনেদি বাড়ি ভাগ হয়ে গেছে। ভাগ হয়েছে পুজো। এখন পাশাপাশি দুই বাড়িতেই দুর্গা পুজো হয় আর দু-বাড়িরই দেবীর রং নীল। চট্টোপাধ্যায় পরিবারের আদি নিবাস ছিল বাংলাদেশের বরিশাল জেলার রামরাইন গ্রামে। সেখানেও পুজো হত। তবে গোড়া থেকেই এই দুর্গাপুজোর মূর্তি নীল রঙের ছিল না। এখানেও বংশপরম্পরায় গল্প চালু রয়েছে। প্রতিমা শিল্পী রাতের অন্ধকারে ভুল করে নাকি দেবী মূর্তির গায়ের রং নীল করে ফেলেছিলেন। পরদিন সকালে পুজো। তখন আর কোনও উপায় ছিল না। সেই থেকে এ বাড়ির দেবীমূর্তির রং নীল।
নদিয়া জেলায় লাল ও নীল দুর্গার পরই এসে পড়ে কালো দুর্গার কথা। হাঁসখালির বাহিরগাছি গ্রামে যে দুর্গাপুজো হয়, সেই দেবী মূর্তির গায়ের রং কুচকুচে কালো। তবে এ পুজো বনেদি বাড়ির নয় আশ্রমের। যেটি এলাকায় শান্তি আশ্রম বলে পরিচিত। একসময় এই পুজো ছিল বাংলাদেশের পাবনা জেলার স্থলগ্রামের জমিদারবাড়ির। ওই বাড়ির বংশধর সন্ন্যাসী হয়ে ঘর ছেড়ে বাহিরগাছিতে এসে আশ্রম প্রতিষ্ঠা করে দুর্গা পুজো শুরু করেন। পাবনার স্থল গ্রামের দুর্গা মূর্তির রংও হত কুচকুচে কালো। সেখানেও ভুল করে কালো রং করে ফেলার গল্প, বিগত পঁয়তাল্লিশ বছর ধরে শান্তি আশ্রমের দুর্গা পুজোর মূর্তির রং ঐতিহ্য মেনেই কালো।
বঙ্গদেশের দুর্গাপুজোয় বিচিত্র দুর্গামূর্তির ছড়াছড়ি। কালো-নীল-লাল দুর্গা মূর্তি যেমন পুজো হয়, তেমনই ঘটে অন্য মূর্তিকে ঘিরে দুর্গা পুজো। মল্লারপুর জমিদার বাড়ির দু-হাতের দুর্গা প্রতিমা, হুগলি জেলার বলাগড় এলাকার সোমড়া গ্রামের ত্রিভূজা দুর্গামূর্তি পুজো, বর্ধমানের ক্ষীরগ্রামে নবপত্রিকায় দুর্গাপুজো, মুর্শিদাবাদের রানিনগর এলাকার ইসলামপুরে বাইশ মূর্তির দুর্গা পুজো, বালুরঘাট শহর থেকে ১৫ কিমি দূরে ফুলঘরা গ্রামে দুর্গাপুজোর চারদিন মনসা পুজো, হুগলির শ্রীরামপুরে পাইন পরিবারে হর-গৌরীর মূর্তি ঘিরে দুর্গাপুজো, উত্তর ২৪ পরগনার অশোকনগরের ধর পরিবারে গণেশ-জননী মূর্তি ঘিরে দুর্গাপুজো, কাটোয়ার কেতুগ্রামের খাটুন্দি ভট্টাচার্য বাড়িতে এক উঠোনে সাতটি দুর্গাপুজো—এ সবই বিচিত্র এবং আশ্চর্যময়।
বঙ্গদেশের দুর্গাপুজোর বিস্ময় ফুরিয়ে যায় না এখানেই। দুর্গাপুজো বা বঙ্গদেশের শ্রেষ্ঠ উৎসব ঘিরে বলার মতো আছে আরও কিছু। বীরভূমের রামপুরহাট ব্লকের বসোয়া গ্রামে কোনও ব্রাহ্মণের বাস নেই কিন্তু গত চুয়াল্লিশ বছর ধরে এই গ্রামে একমাত্র দুর্গাপুজো করে আসছে অব্রাহ্মণ পুরোহিত। অন্যদিকে আসানসোল থেকে ২০ কিমি দূরের ধেনুয়া গ্রামে মহালয়ার দিনই সপ্তমী, অষ্টমী ও নবমী পুজো শেষ করে ওই দিন বিকেলেই হয় বিসর্জন। পুজোর চারদিন যখন সবাই আনন্দে মাতোয়ারা তখন কোচবিহারের মাথাভাঙা ব্লকের ইন্দেরকুঠি গ্রামের একটি সম্প্রদায়ের মানুষ থাকেন মুখ ঘুরিয়ে। নিজেদের অসুরবংশীয় বলে পরিচয় দেন ওঁরা। দেবীর হাতে অসুর বধ হয়েছিল বলে এই ক-দিন তাঁরা থাকেন সবচেয়ে দুঃখে।
Be the first to comment