মধ্য রাতে আচমকাই হামলা আরজি করে, লণ্ডভণ্ড জরুরি বিভাগ, নামল র‍্যা‍ফ, পৌঁছাল পুলিশ কমিশনার

Spread the love

চিরন্তন ব্যানার্জি:-

আরজিকর হাসপাতালে ছাত্রীকে নৃশংসভাবে হত্যার ঘটনার প্রতিবাদে স্বাধীনতা দিবসের মধ্য রাতে গোটা রাজ্য জুড়ে মহিলারা রাত দখলের ডাক দিয়েছিলেন। সেই মতোই বুধবার মধ্য রাতে শান্তিপূর্ণ ভাবেই হচ্ছিলো কর্মসূচি। ঘড়ির কাঁটায় তখন রাত ১২টা বেজে গিয়েছে, হটাৎ করেই সেই আরজি কর, যার প্রতিবাদে গোটা রাজ্যে শান্তিপূর্ণ কর্মসূচির ডাক দেওয়া হয়, সেই হাসপাতালেই ঘটে গেল তাণ্ডবলীলা। তছনছ করা হল হাসপাতালের জরুরি বিভাগ। ভেঙে ফেলা হল আন্দোলনকারীদের মঞ্চও।
রাত তখন প্রায় ১২টা রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে যেভাবে রাত দখলের কর্মসূচিকে ঘিরে ছান্ডা ছাড়া মিছিল শুরু হয়, ঠিক সেভাবেই শ্যামবাজার পাঁচমাথা মোড় থেকে আরজি করের দিকে এগোচ্ছিল মেয়েদের রাত দখলের কর্মসূচির একটি মিছিল। ঠিক সেই সময়েই, একদল ব্যক্তি আরজি করের জরুরি বিভাগের বাইরে তাণ্ডব চালান। অভিযোগ তাদের কয়েকজনের হাতে ছিল রড, লাঠি। তারা ঢুকে পরে হাসপাতাল চত্বরে। প্রথমেই ভেঙে ফেলা হয় পাঁচ দিন ধরে যেখানে বসে জুনিয়র চিকিৎসকরা আন্দোলন করছিলো সেই মঞ্চ। তারপর ওই হামলাকারীরা জরুরি বিভাগের বাইরে কোলাপসিবল গেট ভেঙে ভিতরে ঢুকে পরে। ভেঙে ফেলা হয় জরুরি বিভাগের মধ্যে আরেকটি কোলাপসিবল গেটেও। এরপরই ভিতরে ঢুকে সব কিছু লন্ডভন্ড করে দেন তাঁরা। ভেঙেচুরে ফেলা হয় জরুরি বিভাগের সব কিছুই। টিকিট কাউন্টার, এইচসিসিইউ, সিসিইউ, ওষুধের স্টোররুম, জরুরি বিভাগের যেখানে পুরুষ ও মহিলাদের চিকিৎসা করা সেই ঘর গুলো হামলাকারীদের হাতে চুরমার হয়ে যায়। লন্ডভন্ড করে দেওয়া হয় জরুরি বিভাগের অক্সিজেন সাপ্লাইয়ের লাইনগুলোও।
মেঝেতে ছড়িয়ে পড়ে লক্ষাধিক টাকার জীবনদায়ী ওষুধপত্র, ইঞ্জেকশনের ভাঙা ভায়াল। ওলটপালট করে দেওয়া হয় বেড, আসবাবপত্র। গোটা জরুরি বিভাগ জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে চুরমার হওয়া কাচ। হামলাকারীদের হাত থেকে রেহাই পায় নি জরুরি বিভাগের পুলিশ ফাঁড়িটাও। লন্ডভন্ড করে দেওয়া হয় জরুরি বিভাগের সিসিটিভি রুম, ভেঙে তছনছ করে দেওয়া হয় ফুটেজ সংরক্ষণ হার্ডডিক্স, মনিটরগুলোও।
ভিতরের পাশাপাশি হামলা চালানো হয় হাসপাতালের বাইরেও। হাসপাতাল চত্বরে রাখা একের পর এক বাইকে ভাঙচুর চালানো হয়। ভাঙা হয় পুলিশের একাধিক গাড়ি ও বাইক। পুলিশের বসানো সমস্ত গার্ড রেল ফেলে দেওয়া হয়। আক্রমণ চালানো হয় আন্দোলনকারী পড়ুয়াদের মঞ্চেও। মাটিতে আছড়ে ফেলে ভাঙ্গা হলো একের পর এক চেয়ার, চেয়ারের অবশিষ্ট দিয়ে ভাঙার চেষ্টা হল লোহার পাখা। ভাঙছে না দেখে পাখা তুলে আছড়ে দু’টুকরো করা হল চোখের নিমেষে। মঞ্চ ভাঙার জন্য আক্রমণকারীরা যখন উদ্যত, সেই সময় এক মহিলা আন্দোলকারীকে হাত জোড় করে তাঁদের মঞ্চ না-ভাঙার অনুরোধ জানাতেও দেখা যায়। গোটা সময় জুড়ে চলে ইটবৃষ্টিও। প্রায় ৪০ মিনিট ধরে চলে তাণ্ডবলিলা। এর পরেই ঘটনাস্থলে পৌঁছয় বিশাল পুলিশবাহিনী। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে নামানো হয় র‌্যাফ। তারা এসে কাঁদানে গ্যাসের শেল ফাটায়। ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় ভিড়। হামলাকারীদের একাংশকে তাড়া করে এলাকাছাড়া করে পুলিশ। কিন্তু তার পরেও পরিস্থিতি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আসেনি। পুলিশকে লক্ষ্য করে ইট ছোড়া হয়। পুলিশের তাড়া খেয়ে একদল লোককে হাসপাতালের পাশের খালপাড় ধরে গলিপথে দৌড়তে দেখা যায়। সেখান থেকে পুলিশকে লক্ষ্য করে ছোড়া হয় ইট। হামলাকারীদের ছোড়া ইটে মানিকতলা থানার ওসি সহ বেশ কয়েকজন পুলিশকে জখম হতে হয়।
এরপর রাত প্রায় দেড়টা নাগাদ হাসপাতালে আসেন কলকাতার পুলিশ কমিশনার বিনীত গোয়েল। একসময় তিনি মেজাজ হারিয়ে বলেন, ” সংবাদমাধ্যম ও সোশ্যাল মিডিয়ার ভুল প্রচারের জন্য আজ এই অবস্থা। গুজব ছড়িয়ে মানুষ খেপানো হয়েছে। আমরা সমস্ত চেষ্টা করেছি যথাযথ তদন্ত করার। তারপরেও গুজব ছড়ানো হয়েছে।”
পুলিশ সূত্রের দাবি, বুধবার শান্তিপূর্ণ আন্দোলন বলে লাঠি ছাড়াই পুলিশ রাখা হয়েছিল হাসপাতালের গেটে। একসঙ্গে অত জন লাঠি হাতে ঢুকে আসবে, তা তারা নাকি ভাবতেই পারেনি। হামলাকারীদের দল বাইরে দেদার তাণ্ডব চালিয়ে হাসপাতালে জরুরি বিভাগের যখন সব কিছু লণ্ডভণ্ড, যখন পুলিশ কর্মীরাও আক্রান্ত ততক্ষণে কিছুটা ধাতস্থ হয়েছে পুলিশ। মাথা থেকে রক্ত ঝরা অবস্থায় তাদের কাউকে কাউকে লাঠি হাতে ছুটে যেতে দেখা যায়।
এর ঘটনার পরই উঠছে একাধিক প্রশ্ন। একটি শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের সময়ে কারা এমন ঘটাল? এমন ঘটতে পারে বলে কোনও খবর কেন ছিল না পুলিশের কাছে? প্রশ্ন উঠছে, হাসপাতালের ভিতরে পুলিশ ইনচার্জ রুমেও ভাঙচুর চালানো হয়েছে। ওই রুমেই সমস্ত সিসিটিভি ফুটেজ স্টোর করা হত। অভিযোগ উঠেছে, বুধবার রাতের ঘটনা সুপরিকল্পিতভাবে ঘটানো হয়েছে যাতে, সব প্রমাণ নষ্ট হয়ে যায়। কারণ রুমে হামলার ঘটনায় সমস্ত হার্ড ডিস্ক ভেঙে গেছে। পুলিশের দাবি, সেই সময় নিজেদের প্রাণ বাঁচাতেই তারা ব্যস্ত ছিলেন, তাই ভাঙচুর আটকানো সম্ভব হয়নি। অন্যদিকে, পুলিশ ইনচার্জ অবশ্য বলছেন, আগের সিসিটিভি ফুটেজগুলি সংরক্ষণ করা আছে, কিন্তু বুধবার রাতের ঘটনার সিসিটিভি ফুটেজ সংরক্ষণের আগেই এই হামলা হয়েছে। তাই সেগুলি আর পাওয়া যাবে না বলেই আশঙ্কা।
অন্যদিকে, হাসপাতালের জরুরি বিভাগের গ্রুপ ডির কর্মী শুভঙ্কর সাহা বলেন, ”অন্তত ২৫০-৩০০ লোক ঢুকেছিল। ব্যারিকেড ভাঙার আগে তাদের বারণ করা হয়েছিল কিন্তু কেউ শোনেনি। হাসপাতালের অ্যাসিস্টেন্ট সুপার সেই সময় ডিউটিতে থাকলেও তাঁদের খোঁজ নেননি। কেন নেননি সেই প্রশ্ন করব।” তাঁর এও হুঁশিয়ারি, এই হামলার ঘটনার পর তাঁদেরও সুরক্ষা নিয়ে যদি ভাবা না হয় তাহলে তাঁরা কাজ বন্ধ করে দেবেন। ওই কর্মী এও জানিয়েছেন, রাতের হামলার সময় তাঁরা এমারজেন্সিতে ৪-৫ জন কর্মী ছিলেন। সকলের কোনও রকমে প্রাণ বাঁচিয়ে হাসপাতালের অ্যাসিস্টেন্ট সুপারের ঘরে যান সাহায্য চাইতে। তবে তিনি ঘর থেকে বের হননি। বরং বলেছিলেন পুলিশ নাকি তাঁকে ঘরেই থাকতে বলেছে! কিন্তু হাসপাতালে পুলিশ থাকা সত্ত্বেও কী ভাবে এত বড় ঘটনা ঘটল? শুভঙ্কর বলছেন, যে পরিমাণ লোক ঢুকেছিল তাদের সামলানোর মতো পুলিশ বাহিনী তখন ছিল না। দিলীপ নামের আরও এক কর্মী জানান, চলতি মাসেই তাঁদের এক সহকর্মী অবসর নেবেন। তাঁকে পর্যন্ত মারা হয়েছে, তিনি কোমরে চোট পেয়েছেন। তাই এই ঘটনার একটা হেস্তনেস্ত করে ছাড়বেন তাঁরা।
উল্লেখ্য, এই ঘটনার পর রাতেই তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় এক্স হ্যান্ডলে একটি পোস্ট করে কলকাতার পুলিশ কমিশনারের কাছে আর্জি জানিয়েছেন, ‘‘রং না দেখে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে দুষ্কৃতীদের ধরুন! পড়ুয়াদের দাবি ন্যায্য ও সঙ্গত! তাঁদের বাঁচান!’’

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*