বঙ্গ বিজেপির দীর্ঘদিনের সৈনিক তাঁরা। কিন্তু বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠতেই প্রথমে শোকজ নোটিস আর তারপর দল থেকে সাময়িক বরখাস্ত। শৃঙ্খলাভঙ্গের তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত বরখাস্ত থাকবেন জয়প্রকাশ মজুমদার এবং রীতেশ তিওয়ারি। দলের এই ‘কঠোর’ সিদ্ধান্তে যথেষ্টই অভিমানী দুই বিক্ষুব্ধ নেতা। মঙ্গলবার বিকেলে সাংবাদিক বৈঠকে জয়প্রকাশের গলায় সেই অভিমানের সুর স্পষ্ট। বললেন, “বিজেপিতে আট বছর রয়েছি। ২০১৫ সাল থেকে রাজ্য বিজেপিতে সহ-সভাপতির পদে আছি।” তাঁর মতে বাংলায় বিজেপির যে দ্রুতগতির উত্থান হয়েছে, তা অনেকেই ভালভাবে নিচ্ছেন না। বাংলার বিজেপিকে দুর্বল করার চেষ্টা চলছে বলেও অভিযোগ করেন তিনি।
জয়প্রকাশ মজুমদার মঙ্গলবার বলেন, “আমি পশ্চিমবঙ্গের গত ৩৫ বছরের রাজনীতির সঙ্গে সর্বতোভাবে সম্পৃক্ত হয়ে জড়িয়ে আছি। বিজেপিতে ২০১৪ সালে যোগ দেওয়ার পরের বছরই বিজেপি আমাকে রাজ্যের সহ সভাপতি করে। তার পরের বছর আর একটি দায়িত্ব দেয়, যা অনেকেরই অজানা। রাজনৈতিক বিশ্লেষণ বিভাগ রয়েছে রাজ্য বিজেপির। তার দায়িত্ব আমাকে দেওয়া হয়। তা কেন্দ্রকে নিয়মিত পাঠানোর দায়িত্ব ছিল আমার। সেই কাজ ২০২১ -এর নির্বাচনের আগে এবং পরেও আরও দুই-তিন মাস পর্যন্ত করেছি। কেন্দ্রীয় বিজেপিকে রাজ্যের রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং তার উপর বিশ্লেষণ পাঠানোর দায়িত্ব ছিল আমার।”
তিনি আরও বলেন, “বিজেপি ২০১৬-র নির্বাচন তিনটি কেন্দ্রে জয়ী হয়েছিল। এরপর ২০১৯-এর নির্বাচনে আমরা ১৮ টি আসন জিতে আসি। বিজেপি এই রাজ্যে এক অভূতপূর্ব জায়গায় পৌঁছায়। প্রধান প্রতিপক্ষ হয়ে উঠে আসে। আমার তার পর থেকেই মনে হচ্ছিল, যে কোনও কারণেই হোক না কেন, বিজেপির এই উত্থানকে কেন্দ্রীয় কিছু নেতা এবং রাজ্যের কয়েকজন নেতা, ভালভাবে মেনে নিতে পারছেন না। বাংলার বিজেপিকে দুর্বল করার চেষ্টা শুরু হয়। ২০১৯ -এর পর থেকে এই বাংলায় দেখতে পাই, বাংলার যে নেতা – কর্মীরা ১৮ টি আসন জেতাল এবং দুটি আসন অল্পের জন্য হেরে গেল – এই পর্যায়ে বিজেপিকে নিয়ে আসল, তাদের উপর আর ভরসা করা যাবে না – এমন একটা উদ্যোগ শুরু হল। হয় অন্য দল থেকে লোক নিয়ে আসতে হবে, নাহলে বাইরে থেকে লোক নিয়ে এসে বাংলার বিজেপিকে তরী পার করাতে হবে। আমি তখন থেকেই কেন্দ্রের কাছে পাঠানো ফিডব্যাকে বলেছি, এটা ঠিক রাস্তা হচ্ছে না।” কিন্তু সেই রিপোর্ট যে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের কাছে খুব একটা প্রশংসিত হয়নি, সেই কথাও স্পষ্ট করে দেন জয়প্রকাশ।
জয়প্রকাশ মজুমদার বলেন, “বাংলার হাজার- লাখ কর্মীর সঙ্গে প্রতারণা করা হচ্ছে। বাইরের লোক নিয়ে এসে নির্বাচন করা হল। বহিরাগত নেতাদের ভালভাবে নেয়নি বাংলার মানুষ। হেস্টিংসের অফিসে ১২ টার পর থেকে যত বড় বড় গাড়ি নিচে দাঁড়িয়ে ছিল, সেগুলির নিষ্ক্রমণ শুরু হল। বড় বড় নেতাদের অ্যাসিন্ট্যান্টরা বলছে – কিতনা জলদি দিল্লি কা ফ্লাইট মিলেগা! বিকেল ৫ টার সময় যখন সব স্পষ্ট, কয়েকটা জায়গায় গণনা বাকি, তখনও নন্দীগ্রাম কে জিতেছে ফয়সলা হয়নি – সেই সময় বিজেপির তরফ থেকে সাংবাদিক বৈঠকে এই জয়প্রকাশ মজুমদার ছাড়া বিজেপির কোনও নেতা সেখানে ছিল না।”
জয়প্রকাশের আরও অভিযোগ, কর্মীদের উপেক্ষা করছে নেতৃত্ব। বাংলায় বিজেপি কর্মীরা ভাল নেই। কোনও জেলা কমিটি আজও তৈরি হয়নি। বিক্ষোভ এড়াতে নেতাদের চুপ রাখা হচ্ছে। একইসঙ্গে তাঁর আক্রমণের নিশানায় রাজ্য বিজেপির সভাপতি সুকান্ত মজুমদার। বললেন, “মাত্র আড়াই বছর রাজনীতিতে এসেছেন সভাপতি। প্রবীণ ও অভিজ্ঞ নেতারা আজ রাজ্য বিজেপিতে ব্রাত্য।”
বিক্ষুব্ধ নেতা জয়প্রকাশ মজুমদারের কথায়, “ভোট পরবর্তী হিংসা নিয়ে কোনও আন্দোলন হয়নি। আমরা আদালতে গিয়েছি অনেকবার। কিন্তু যে কর্মীরা মার খেয়েছে, তাঁদের পাশে দাঁড়ানো, সেই জেলায় যাওয়া, সেই মণ্ডলে যাওয়া – তার থেকে সবাই বলেছে হাইকোর্টে গিয়ে সেটা কাগজে বেরোলে বেশি সাহায্য হবে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যখন বামফ্রন্টের বিরুদ্ধে ক্ষমতায় আসার জন্য লড়াই করছিলেন, তখন তিনি হাইকোর্টের উপর নির্ভর করে লড়াই করেননি। তিনি মাঠে ময়দানে রাস্তায় নেমে লড়াই করেছিলেন। কারণ, সেটাই বাংলার রাজনীতি। কিন্তু অদ্ভুতভাবে ২০২১-এর নির্বাচনের পরবর্তী ক্ষেত্রে – নির্বাচনের ফলাফলের কোনও পর্যালোচনা হল না। ভার্চুয়াল মিটিংয়ে কেউ কথা তুলতে গেলে তাঁকে চুপ করিয়ে দেওয়া হয়েছে। মাইক অফ করে দিতে বলা হয়েছে।”
Be the first to comment