তপন মল্লিক চৌধুরীঃ
পৃথিবীর এবড়ো-খেবড়ো রাস্তা পেরোতে গিয়ে এমরা এর-ওর-তার কাছ থেকে প্রচুর সাহায্য উপদেশ আশীর্বাদ পেয়ে থাকি, কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমরা যা হয়ে উঠি তা আমাদের নিজস্ব কর্মফল, কেউ-কেউ ঠগ জোচ্চর হই, কেউ কেউ দশটা-পাঁচটা কলম-পেষা সংসারধর্মভীরু করণিক, কচ্চিৎ কেউ-কেউ বা রবি ঘোষের মতো মস্ত বড় মাপের স্রষ্টা, যাঁকে বিপ্লবী বলে আখ্যা দিতে, আমার দিক থেকে অন্তত, কোনও অসুবিধে নেই। একজন অভিনেতা সম্পর্কে মন্তব্যটি অর্থনীতিবিদ অশোক মিত্র-র ‘কেবলমাত্র মন্তব্য নয়,’ অভিনেতা রবি ঘোষ সম্পর্কে বলা ভাল অভিনেতা রবি ঘোষের চরিত্র চিত্রণে তিনি রবিকথন শীর্ষক নিবন্ধে ব্যয় করেছেন প্রায় সাড়ে তিন হাজার শব্দ। সচরাচর একজন অভিনেতার অভিনয় দক্ষতা- মঞ্চ অথবা চলচ্চিত্রে তাঁর গুরুত্ব সম্পর্কে কলম ধরেন উল্লেখিত ওই দুই মাধ্যমের সমালোচক কিংবা কলাকুশলী। কোনও সমাজতত্ত্ববিদ কিংবা অর্থনীতিবিদের আলাপচারিতায় একজন জনপ্রিয় অভিনেতাকে এত গভীর ও আন্তরিক শ্রদ্ধায় ঠাঁই পেতে দেখা যায় না। কারন রবি ঘোষ কেবলমাত্র একজন কৌতুক- অভিনেতা নন। রবি ঘোষ, রামা কিংবা ধনঞ্জয় অথবা নটবর মিত্তির-শেখর-বাঘা ইত্যাদি চরিত্রগুলির সুনির্দিষ্ট ফ্রেম কিংবা মুখোশ অথবা মুদ্রাদোষেই বাঁধা থাকেন না অথচ এঁদেরই মাঝে বসে তাঁর নিজের মুদ্রাদোষে তিনি একাই হতে থাকেন আলাদা।
জন্মেছিলেন স্বধীনতাপূর্ব কলকাতায় পিতৃদত্ত নাম রবীন্দ্রনাথ ঘোষদস্তিদার থেকে রবি ঘোষ হওয়ার ইতিবৃত্তে রয়েছে আকীর্ণ অর্থাভাব, হতজীর্ণ সংসারের মালিন্য, প্রতিদিন দুরূহ থেকে দুরূহতর হয়ে ওঠা জীবন, সেই পরিবেশকে দীর্ণ করে স্থির লক্ষ্যে এগিয়ে যাওয়া, সাধনা সফল করা, সমস্ত প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালিয়ে কৃতী হতে পারাটা সহজ কাজ নয় মোটেও। কিন্তু রবি ঘোষ পেরেছিলেন তাঁর স্বপ্নকে মাটির পৃথিবীতে নামিয়ে এনে উপস্থাপন করতে। পূর্ববঙ্গ থেকে আসা রবির ছিন্নমূল পরিবার আশ্রয় পেয়েছিল কলকাতার মহিম হালদার স্ট্রিটের পরিসরহীন স্যাঁতসেতে ভাড়া বাড়িতে। বাবা আলিপুর কোর্টে নামমাত্র একটি কাজ করতেন। সব অর্থেই তিনি নিঃস্ব মানুষ, কিন্তু নিঃস্বতার মধ্যেও সম্বল তাঁর চরিত্রবল, ন্যায়-নীতি বোধ। আদালতের সেরেস্তাদারের সামান্য চাকরীতে অঢেল উপরির সুযোগ অথচ নির্মম দরিদ্রের নিষ্ঠুর চাপেও নিজেকে সংযত রেখেছিলেন। ফলত শৈশব থেকেই মর্মান্তিক জীবন যন্ত্রণা সঙ্গী করেই বেড়ে উঠেছিলেন রবি। কিন্তু সারাজীবনে কখনও নিজের দারিদ্রতা, নিঃস্বতা, দুর্ভোগকে হাপিত্যেশ বর্ণনায় পরিবেশন করেন নি। কাছের মানুষদের সঙ্গে সেই হৃদয় বিদারক বিবরণ কখনো কখনো ঠোঁটের কোনে কৌতুকের ছোঁওয়ায় ভাগ করেছেন।
সাউথ সুবার্বন মেন স্কুল থেকে ম্যাট্রিক, এরপর বিজ্ঞান বিভাগের ইন্টারমিডিয়ট পেরিয়ে এসে ভর্তি হন আশুতোষ কলেজে। দিনগুলি রাতগুলি তখনও কেটেছে নিদারুন অভাব- অনটন, নুন আনতে পান্তা ফুরানোর মালিন্য ঠাসা কুম্ভিপাকে অথচ নিজের বুকের শেল নিয়ে রবি অবিচল। মা-বাবাকে নিয়ে তাঁর সুনিবিড় গর্ব-প্রীতি-ভালবাসা-ভক্তির সম্ভার। এরই পাশাপাশি আছে রবির নাট্যচর্চা। সেখানে মন-প্রাণ সবটাই ঢেলে দিয়েছেন। রক্ষণশীল নাতিবাগীশ বাবা ছেলের এহেন নাট্যচর্চা নিয়ে উন্মাদনাকে একেবারেই বরদাস্ত করতে পারবেন না, কারন যে দারিদ্র-অভাব-অনটনের অন্ধকারে তাঁরা থুবড়ে পড়ে রয়েছেন সেখানে বাড়ির জ্যেষ্ঠ্য সন্তান আলোর বার্তকা হাতে নিয়ে যে অন্ধকার থেকে উদ্ধার করবে সেটাই তো সাধারন নিয়ম। বাবা-মা-বোন-ভাই তো ওইটুকু আশা করবেই। কিন্তু রবি কি সেই ব্যাকরণে হুবহু মান্যতা দেবে? সে তখন ব্রেখট থেকে স্ট্যানিস্লাভাস্কির রচনাবলীতে গভীর মনোযোগী, দিবারাত্র উৎপল দত্তর নাটকে তালিম নিচ্ছে। বাবার সঙ্গে চোর-পুলিশ খেলে বাড়িতে ঢুকছে-বেড়চ্ছে। অভয় প্রশ্রয় মিলছে মায়ের আগলে রাখা থেকে। ইতিমধ্যে কলেজের পাঠ চুকে গিয়েছে। বাবা কোর্টের এক সদয় উপরওয়ালাকে বলে কয়ে সেরেস্তাদার দফতরেই একটি অতি সামান্য কাজ জুটিয়েছেন রবির জন্য। কয়েক বছর দাঁতে দাঁত চেপে তীব্র অনিচ্ছা নিয়েই অপছন্দের সেই কাজ করে গিয়েছেন। কিন্তু অভিনয় চর্চা তাঁকে আরও সুনিবিড় করে রেখেছে। আদালতের কাজে অন্তরের সায় আর পাচ্ছিলেন না রবি।
বাবা-মাকে কুপিত করে একদিন সেরেস্তাদার দফতরের কাজ ছেড়ে অভিনয় চর্চায় আরও মনোযোগী হলেন রবি। তখনও কি কেউ বুঝেছিলেন ‘অঙ্গার’- এর সনাতন ‘কিছুক্ষণ’, ‘মেঘ’, ‘হাঁসুলি বাঁকের উপকথা’। ‘অভিযান’, ‘আগুন’, ‘পলাতক’, ‘ন্যায়দন্ড’, ‘ছায়াসূর্য’, ‘নির্জন সৈকতে’, ‘অবশেষে’, ‘শুভা ও দেবতার গ্রাম’, ‘আরোহি’, ‘মহাপুরুষ’, ‘স্বপ্ন নিয়ে’, ‘পাদি পিসির বর্মি বাক্স’, ‘বসন্ত বিলাপ’, ‘বাঘিনী’, ‘কোরাস’, ‘বাঞ্ছারামের বাগান’, ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’, ‘জণঅরন্য’, ‘গুপি গাইন বাঘা বাইন’, ‘সবুজ দ্বীপের রাজা’ ইত্যাদি ছবিগুলির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অভিনেতা হিসাবে স্বীকৃতি পাবেন। অনেকেই কৌতুক- অভিনেতার তকমা এটেছেন রবি ঘোষের অভিনয় প্রতিভায়। অত্যন্ত ভুল, যেমন তাঁর অভিনয় দক্ষতার বিশ্লেষণে উৎপল দত্ত কিংবা সত্যজিৎ রায়ের প্রভাব বিবেচনাও জরুরী নয়। কারন রবি ঘোষ তাঁর চরিত্র নির্মাতা থেকে পরিচালকের অনুশাসন মাথায় রেখেও সেই চরিত্র চিত্রণে তাঁর মুদ্রাদোষের ছাপ রেখেছেন। কখনো তা তাঁর ভ্রু বা চিবুকের ক্ষনিক মুহুর্তের ব্যঞ্জনায় কিংবা কথা বলার বিশিষ্ট ভঙ্গিমায়। আসলে রবি ঘোষ সম্পূর্ণ ভিন্ন মার্গের অভিনেতা। তাঁর উচ্চতা যেমন অভিনব বিচরণও তেমনই অসাধারণ। অভিনয়ের মধ্যে দিয়ে কৌতুকের যে বিচ্ছুরণ তা কিন্তু একেবারেই মজা নয়। নিছক মজাটাই যেন এক উত্তরণ যা অন্য মার্গের অভিনেতার একটি পরিচয় মাত্র। অভিনেতা রবি ঘোষের অভিনীত যে কোনও চরিত্রের মুখ মনে করে দেখুন কেমন করে তিনি বদলে দিতেন মুখের রেখা, চোখের দৃষ্টি, যেমন তাৎক্ষণিকতা তেমনই গভীরতা এই অভিব্যক্তির এবং অভিনয় ভাষার- না একে কমিক বলা বড় ভুল হয়ে যায়।
Be the first to comment