পিয়ালি আচার্য :
অন্ধকারের উৎস হতে উৎসারিত আলো/ সেই তো তোমার আলো/ সকল দ্বন্দ্ব বিরোধ মাঝে জাগ্রত যে ভালো/ সেই তো তোমার ভালো।
আলোর উৎসবে মাতোয়ারা হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি আমরা। কালীপুজো ও দীপাবলিতে শুভ শক্তির অর্চনা করব আমরা, প্রতি বছরের মতো এবারও। এবারে ১৯ অক্টোবর কালীপুজো। তার আগের দিন বাংলায় পালিত হয় ভূত চতুর্দশী। ১৪ পিদিম জ্বালিয়ে ভূত তাড়ানো হয়। যুক্তিবাদী বিজ্ঞানমনস্করা ভুত মানুন বা না-ই মানুন, ভূত থাকুক বা না থাকুক, আমাদের দেশ তথা বিশ্বের মাথা থেকে সন্ত্রাস আর সাম্প্রদায়িকতার ভূত নেমে যাক—এটাই কামনা।
কালীপুজোর দিন কেউ কেউ সমৃদ্ধির দেবতা লক্ষ্মী-গণেশের পুজো করেন। দিল্লি-সহ উত্তর ভারতেই শুধু নয়, দেশের অন্যান্য প্রান্তে এবং বিদেশেও এই পুজো হয়। বাংলায় অনেকে কুলোর বাতাস ও ঝাঁটা দিয়ে অলক্ষ্মী তাড়ান কালীপুজোর দিন। একইসঙ্গে পুজো হয় সুখ-সমৃদ্ধির দেবী মহালক্ষ্মী এবং অশুভ শক্তির বিনাশিনী প্রচণ্ড শক্তির প্রতীক মা কালীর। দীপাবলির আলোকে উদ্ভাসিত হয় জগৎ। কবিগুরু যথার্থই লিখেছেন, ‘জ্বালাও আলো আপন আলো সাজাও আলো ধরিত্রীরে।’
অবশ্য বর্ষা বিদায়ের ঘণ্টা বাজার আগেই এবারে মা দুর্গা এসেছেন ধরাধামে। বেজে উঠেছে আলোর বেণু, আশ্বিনের শারদ প্রাতে মেঘ-রৌদ্রের লুকোচুরির মাঝে এসেছে শিউলি সকাল। কাশের দোলা জানান দিয়েছে শরৎ এসেছে। ১৯ সেপ্টেম্বর মহালয়ায় দেবীপক্ষের সূচনা হয়েছে। জাগো দুর্গা, জাগো দশপ্রহরণধারিণী মন্ত্রে আকাশ-বাতাস মুখরিত হয়েছে।
তবে এবারে আনন্দ উৎসবের মধ্যেও ছিল সাম্প্রদায়িকতার চক্রান্ত। বিভেদ ফণা তুলে ভয় দেখাতে তৈরি হচ্ছিল। আনন্দের বিষয় বাংলার মানুষ সব চক্রান্ত ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়ে আরও একবার প্রমাণ করল আমাদের ঐতিহ্য, কৃষ্টি, সংস্কৃতি সাম্প্রদায়িকতাকে প্রশ্রয় দেয় না। বিভেদের ফণা এখন শীতঘুমের প্রস্তুতি নিচ্ছে। তাই দুর্গোৎসব ও মহরম পালিত হলো শান্তিতে। আদালতের অতি সক্রিয়তা একই দিনে ভাসান ও মহরমের নির্দেশ দিলেও বাংলার মানুষ সেই পরিস্থিতিতেও থাকলেন শান্ত, বজায় রাখলেন সৌহার্দ্য।
এক্ষেত্রে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সক্রিয় ভূমিকা অবশ্যই উল্লেখযোগ্য। আসলে মনে-প্রাণে তিনি সর্বধর্ম সমন্বয়ে বিশ্বাস করেন। ভারতবর্ষের গণতান্ত্রিক কাঠামো তথা সংবিধানের উপর শ্রদ্ধাশীল তিনি। তাই তো দৃঢ় কণ্ঠে বলতে পারেন, আমি কোনও জাতি, সম্প্রদায়ের মুখ্যমন্ত্রী নই, আমি সবার মুখ্যমন্ত্রী। আর তাঁর নেতৃত্বে পুলিশ প্রশাসন যে কাজ করলো তা এককথায় অভূতপূর্ব।
একদিকে যেমন উৎসবকে কেন্দ্র করে ভিড় সামলানো, অন্য দিকে উৎসবকে বিভিন্নভাবে সাফল্যমণ্ডিত করে তোলা। সর্বোপরি শান্তি ও সংহতি বজায় রাখা। একাধারে এই শারদোৎসবে বিভিন্ন ভূমিকা পুলিশ যেভাবে পালন করলো, তাতে তাদের স্যালুট জানাতে হয়।
১৪ অক্টোবর দার্জিলিং-এ গুরুং-বাহিনীর হিংসার বলি হলেন তরুণ পুলিশ অফিসার অমিতাভ মালিক। এবারের দেওয়ালিতে আলোকমালায় সাজবে না তার বাড়ি। তাঁর স্ত্রী বিউটির কাছে সারা জগৎই এখন অন্ধকার। এই সন্ত্রাস, এই হিংসা কেন? কি এর উদ্দেশ্য? এই হিংসার বিরুদ্ধেও আসুন সবাই একটাই প্রার্থনা করি, ‘বরিষ ধরা মাঝে শান্তিরও বারি।’
৩০ তারিখ ছিল দুর্গাপুজোর দশমী। অবশ্য ৪ তারিখ লক্ষ্মীপুজোর আগের দিন পর্যন্ত ছিল বিসর্জন। কোনওরকম অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি বাংলায়। এরই মাঝে এসেছে ২ অক্টোবর জাতির জনক মহাত্মা গান্ধীর জন্মদিন। অহিংসার প্রতীক বাপু-র জন্মদিনে দেশের বিভিন্ন জায়গা ছিল অশান্ত। এবং আমেরিকার লাস ভেগাসে বন্দুকবাজদের হানায় প্রায় ১০০ জন মানুষের মৃত্যু হয়। কিন্তু ব্যক্তিক্রম বাংলা। এটা ঠিক, বাংলা ভারত তথা বিশ্বেরই একটা অংশ। অশান্তির চাবুক দেশমাতৃকার পিঠে পড়লে তার আঘাতে শিহরিত হয় বাংলাও। কিন্তু সুযোগ্য নেতৃত্ব ও সচেতন জনগণ মিলে কীভাবে শান্তির বাতাবরণ বজায় রাখা যায় তার দৃষ্টান্ত হয়ে রইল পশ্চিমবঙ্গ।
এরপর ৩ অক্টোবর সারা বিশ্বের মানুষ প্রত্যক্ষ করলেন বিসর্জন কার্নিভাল। গতবারের পর এবার। আরও পরিণত, আরও সাজানোগোছানো। শুধু চেতলা অগ্রণী বা আলাপী বা সুরুচি সংঘ বা এভারগ্রিনের মতো বড়ো পুজো নয়, সারা কলকাতা এবং হাওড়ারও ছোটো-বড়ো মিলে ৬৮টি পুজো শোভাযাত্রা করে যখন ইন্দিরা গান্ধী সরণী (রেড রোড) দিয়ে যখন গেল তখন সকলের মুখে একটাই কথা, সাধু! সাধু!
৫ অক্টোবর লক্ষ্মীপুজোও পালিত হলো শান্তিতে। কোজাগরী পূর্ণিমায় সুখ, সমৃদ্ধির দেবীর আরাধনা করলেন সবাই। গৃহবধূরা তো বটেই, সেলিব্রিটিরাও মা লক্ষ্মীর আরাধনায় ব্যস্ত থাকলেন। একাধারে অভিনেত্রী সাংসদ শতাব্দী রায় জানালেন, মা দুর্গা চলে যাওয়ার পর একটা শূন্যতা, একটা দুঃখের আবহ তৈরি হয়। লক্ষ্মীপুজোয় সরাসরি অংশগ্রহণ করে দুঃখ ভুলে আমরা আবার মেতে উঠি। কথা হচ্ছিল অভিনেত্রী ইন্দ্রাণী হালদার ও অপরাজিতা আঢ্যর সঙ্গে। সকলেরই এক বক্তব্য, শান্তি ও সম্প্রীতি বজায় থাকুক দেশ তথা বিশ্বে। তবেই তো আসবে সুখ-সমৃদ্ধি, তবেই তো উৎসবের সার্থকতা।
এরপর আমরা দিন গুনছি কালীপুজো ও দীপাবলির। মনের সব কালিমা দূর করে সমস্ত প্রকোষ্ঠে প্রদীপ জ্বালান মা—এটাই প্রার্থনা। ভাইফোঁটাকে কেন্দ্র করেও সম্প্রীতি ও ভালোবাসার আবহ সৃষ্টি হয়। এরপর জগৎজননী আবির্ভূতা হবেন জগদ্ধাত্রী রূপে। কৃষ্ণনগর বা চন্দননগরই শুধু নয়, বাংলা তথা দেশের বিভিন্ন জায়গায় বাড়িতে ও মণ্ডপে হবে জগদ্ধাত্রী পুজো। আলোর রোশনাই, প্যাণ্ডেলের সৌকর্য দেখে অভিভূত হবো আমরা। আসলে শরৎকাল তো উৎসবের ঋতু। ছট পুজো, কার্তিক পুজো, পরপর আসবে আরও কত উৎসব। আমাদের বারো মাসে তেরো পার্বণ। ১৭ সেপ্টেম্বর বিশ্বকর্মা পুজোয় লাটাই ঘুরিয়ে শরতের আকাশে আনন্দের যে রঙিন ঘুড়িগুলি আমরা ছেড়ে দিই, তার রেশ থেকে যায় সারা বছর ধরে। আর উৎসবের মূল মন্ত্রই তো হলো শান্তি ও সংহতি। অসুরবিনাশিনী হিসেবেই হোক বা মুণ্ডমালিনী উগ্রচণ্ডা রূপে হোক, মা তো আসলে ধরায় আসেন সন্তানদের রক্ষা করার জন্য। তাই তো তাঁর শক্তিরূপের পাশাপাশি মাতৃরূপের, কন্যারূপের আরাধনা হয়। সকলে প্রার্থনা করেন, ‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে’। উৎসবেরই আনন্দময় পরিবেশে আসুন আমরা সকল ক্লেদ, মালিন্য, ভেদাভেদ ভুলে বলি, ‘আলোকের এই ঝর্ণাধারায় ধুইয়ে দাও।’
Be the first to comment