পিয়ালী আচার্যঃ এই প্রতিবেদন যখন লিখছি তখন পাহাড়ে সিংমারিতে পায়ে হেঁটে জনসংযোগ করছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়। এখন পাহাড় শান্ত। মমতার পরশে হাসছে পাহাড়, কিন্তু এইরকমই সিংমারিতে তাঁকে পায়ে হেঁটে জনসংসযোগ করতে দেখেছিলাম ২০১৭ সালের ৯ই জুন। তখন পরিস্থিতি এতটা ভালো ছিলো না। এখানেই মমতা ব্যানার্জীর মৌলিকত্ব যে অকুতোভয় তিনি। বিপদসঙ্কুল পাহাড়ে সেদিনও পায়ে হেঁটেই মানুষের সমস্যার কথা শুনেছিলেন তিনি। আপনাদের সুবিধার জন্য ফ্ল্যাশব্যাকে যাচ্ছি।
২০১৭ সালের ৮ই জুন, দার্জিলিং-এ হল রাজ্য মন্ত্রীসভার বৈঠক। এর আগে সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায়ের আমলে পাহাড়ে বসেছিল মন্ত্রীসভা। এই দুই বৈঠকেই কমন মন্ত্রী সুব্রত মুখার্জী ৮তারিখ বৈঠক শেষে স্মৃতিচারণ করছিলেন। বৈঠক শেষ করার পর সাংবাদিক সম্মেলন করলেন মুখ্যমন্ত্রী। পাহাড়ের জন্য শুধুই প্রতিশ্রুতি নয় বেশকিছু উপহার দিলেন। মুখ্যমন্ত্রী বেরিয়ে যাওয়ার পর আমরা সাংবাদিকরা খবর পাঠানোয় ব্যস্ত ছিলাম। হঠাৎ দেখি মন্ত্রীদের মধ্যেই ইতিউতি অস্বস্তি। রাজভবন থেকে বেরোনোর পর এক সাংবাদিক বললেন, পটকা ফাটছে – প্রাপ্তি যোগে খুশি পাহাড়।
দুপা এগোতে শুনলাম, না এটা বাজি পটকার আনন্দ ধ্বনি নয়, গুলি-বোমার সশব্দ শাসানি। ভানুভক্ত ভবন দখল করেছেন গুরুং বাহিনী। স্পর্ধা ছড়িয়েছে রাজভবন পর্যন্ত। কার্যত অভিমন্যুর মত অবস্থা রাজ্যের মন্ত্রীদের। এক সিনিয়র সাংবাদিক মুখ্যমন্ত্রীকে ফোনে জানালেন সব কথা। বললেন, পরিস্থিতি খুব খারাপ। সেনা নামানোর মত অবস্থা। নামলো সেনা। তারমধ্যেই গেরিলা কায়দায় ইট, পাথর, পেট্রোল বোমা বৃষ্টি। আহত হলেন এস পি অমিত জাভালগি থেকে শুরু করে পুলিশ কর্মীরা। কর্তব্যরত সাংবাদিকদেরও আঘাত লেগেছে অল্পবিস্তর। এই জটিল পরিস্থিতির জন্য ভালো লেগেছিল দার্জিলিং-এর ডি এম জয়শী দাশগুপ্তর সাহস দেখে। হেলমেট পড়ে ঘটনাস্থলে হাজির তিনি। যাই হোক পুলিশ ভ্যান জ্বালানো থেকে যা ৮ই জুন শুরু হয়েছিলো তা চললো বেশ কয়েকমাস ধরে। পাহাড় হলো রক্তাক্ত, পাহাড় হলো অশান্ত।
এরপর দার্জিলিং যাই ২৬শে ডিসেম্বর, ২০১৭। ২৭ তারিখ থেকে পর্যটন উৎসব। এবারে নামকরণ তিস্তা-রঙ্গীত পর্যটন উৎসব। অবিশ্বাস্যভাবে দেখলাম পাহাড় শান্ত চড়াই-উতরাইতে বেজে উঠেছিল ক্রিসমাস ক্যারল। নতুন বছরে নতুন দিনের গানে মুখরিত পাহাড়ের আকাশ-বাতাস। উৎসবে মেতেছিলেন সবাই। তবে কি বিমল গুরুং-এর দিন শেষ? না, আমার তা মনে হয় নি। ২৭, ২৮, ২৯ ডিসেম্বর পাহাড়ে উৎসবের মধ্যে দেখেছি Welcome Gurung গায়ে লিখে ঘুরছে অনেকেই। গুরুং-ই যে সুভাষ ঘিসিং-কে কালা বিল্লি বলতেন, যাকে পাহাড়ে উঠতে দিতেন না, তার সমর্থকও দেখেছিলাম পাহাড়ে। ছিল অন্য পাহাড়ের রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিরা। তবে অশান্ত কোথায়? আসলে এখানে মমতা ব্যানার্জীর কৃতিত্ব যে কবিগুরুর বিবিধের মাঝে দেখো মিলন মহান কে সত্য করার চেষ্টা করেন সবসময়।
বারেবারে পাহাড়ে এসে পাহাড়ের মানুষের বিশ্বাস অর্জন করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। একসময় বিমল গুরুং তাঁকে পাহাড়ের মা বলতেন। তৃণমূল কংগ্রেসের পাহাড়ী নেতা বিন্নিরা শুধু তাঁকে মা বলেন না মা মানেনও। বাস্তবিক Head of the State হিসেবে পাহাড়ের সমস্যা বুঝে উন্নয়ণে জোর দেন মমতা। রাজনীতি থাকুক, কিন্তু খালি পেটে রাজনীতি হয়না। দীর্ঘদিন বন্ধ, অচলাবস্থা, ন-অর্থক রাজনীতি করে যুদ্ধ ক্লান্ত পাহাড় তাই মমতার পরশে শান্তি পেয়েছে। উন্নয়ণ হারিয়ে দিয়েছে বিশৃঙ্খলাকে। তাই ৬ই ফেব্রুয়ারি ২০১৮ পাহাড়বাসী আবারও মমতাকে বরণ করে নিয়েছে স্বাদরে। রবীন্দ্রনাথের বক্তব্য দিয়েই শেষ করবো,
অন্ধকারের উৎস হতে উৎসারিত আলো
সেইতো তোমার আলো
সকল দ্বন্দ্ব বিরোধ মাঝে জাগ্রত যে ভালো
সেইতো তোমার ভালো।
Be the first to comment