রাজিত বন্দোপাধ্যায়ঃ
চা দোকানের ফাঁকা বেঞ্চে আধশোয়া হয়ে একটা রিপোর্ট হোয়াটস অ্যাপে লিখে কাগজের অফিসে পাঠানোর চেষ্টা করছিল অনিকেত । গেল গেল রবে চমকে উঠে কোনমতে পকেটে ফোনটা গলিয়ে দিয়ে ছুট লাগাল । কয়েক হাত দূরে চলে যাওয়া রাস্তায় পড়ে গিয়েছে মেয়েটা । ট্রাক টা আসবার আগেই ছুটে গিয়ে তাকে কোলে তুলে নিয়ে রাস্তার এধারে কোনমতে লাফিয়ে পড়ল সে । মাত্র কয়েক সেকেন্ডের জন্য বেঁচে গেল এ যাত্রায় দুজন ।
মেয়েটাকে একটা কড়া ধমক লাগাতে গিয়ে হঠাৎ স্তব্ধ হয়ে গেল অনিকেত । কৃত্রিম পা টা খুলে দূরে ছিটকে পড়ে ছিল । মেয়েটার সুন্দর কোমল ফর্সা মুখে থাকা বড় বড় পেলব যুক্ত অপরূপ চোখ দুটো একটা করুণ দৃষ্টিতে তাকে দেখছে । এত সুন্দর মেয়েটার একটা পা নাই ! কোন কথা না বলে সে কৃত্রিম পা টা কুড়িয়ে এনে দিল তাকে । হাতের স্টিকটাও ছিটকে পড়ে ছিল দূরে , সেটাও কুড়িয়ে নিয়ে এল অনিকেত ।
মেয়েটা ততক্ষণে পরে ফেলেছে পা টা । স্ট্রাইপ বেঁধে সে উঠে দাঁড়াল । হাঁটতে হলে স্টিক টা এখনও লাগছে । ডাক্তার বলেছেন , দুমাস বাদে আর প্রয়োজন হবে না । স্টিক টা হাত থেকে নিতে গিয়ে তার কম্পিত হাত অনিকেত কে স্পর্শ করে গেল । অনিকেত কৃত্রিম স্বরে বললে ,
— তুমি শর্বানী না ?
অনিকেতের প্রশ্নে তার সুন্দর মুখে একটা কঠোরতা এনে শর্বানী বললে ,
— আমাকে আজ আর কেউ বলে মনে হচ্ছে নাকি !
অনিকেত বললে ,
— হুম ! তা ঐ বেঞ্চে একটু বসবে নাকি ?
তার কথায় গম্ভীর মুখে সে বললে ,
— পারলে ভাল হত ।
অনিকেত তাকে ধরে নিয়ে এসে বসিয়ে দিলে পরম যত্নে তার ছেড়ে যাওয়া বেঞ্চে ।
— তা যাচ্ছিলে কোথায় ?
সে কঠোর স্বরে বললে ,
— হাসপাতালে ।
নিউজ টা সেই কভার করতে এসেছিল এই মফঃস্বল শহর রূপনগরে । সেই প্রথম আসা । ভালো লেগে গিয়েছিল এক দেখাতেই ছোট্ট শহরটাকে । আজও মনে পড়ে সেদিন টা ।
— শর্বানী , ও মাধু পিসী গো শর্বানী পড়ে গেছে গো দেখো । দেখো স্কুলের ছাত থেকে গো … মরে গেলো গো বুঝি এতক্ষণে !
উন্মাদের মত ছুটে চলেছে মেয়ে টা রাস্তা ধরে পাগলের মত । রাস্তার অপর পারের ছোট্ট বাড়ি টা তার লক্ষ্য । অনিকেত তার বাইক থামালে।
চা দোকানের বেঞ্চে বসে বিশ্রাম করতে করতে মন টা হঠাৎই চলে গিয়েছিল মাস আষ্টেক আগের দিনটাতে । মাসি বারণ করেছিল ,
— যাসনে । তোর শরীর টা তো ভালো নেই শর্বি।
তবু বই খাতা আর ব্ল্যাকবোর্ডের অদম্য আকর্ষণে সে গিয়েছিল স্কুলে । ভাল ছাত্রী সে ।পড়াশোনা টা মন দিয়ে করে । স্কুল শেষ হলে জ্যোস্না দি তাকে বললে ,
— শর্বানী ঘরটা ঝাড়ু দিয়ে ফেল ।
সে বলেছিল তার শরীর ভাল নেই , পরের দিন সে করে দেবে । কোথা থেকে ছুটে এলেন বিথিকা দি । এসেই বললে ,
— কেন ? আজ তো তোর পরিস্কার করার দিন । করে ফেল ।
সে তার অক্ষমতার কথা জানালে । দুই দিদিমণির চোখে চোখে কথা হল । বিথিকা দি বললেন ,
— করবি না মানে , চল তোকে শাস্তি পেতেই হবে ।
বলে দুজনে জোর করে তাকে নিয়ে চলল তিন তলার ছাতে । জ্যোস্না দি বললে ,
— আজ তোর শাস্তি , পুরো ছাত টা ঝাড়ু করবি।
শর্বানী ফের বললে ,
— দিদি আমার শরীর খারাপ , আমি পারবো না।
চোখ পাকিয়ে তেড়ে এলেন বিথিকা দি । রাগের মাথায় তাকে দিলেন এক ধাক্কা । প্রথম টা কিছু বুঝবার আগেই শর্বানী দেখল সে শূন্যে ভাসছে ! মাথাটা যেন কেমন করে উঠল । তার পর চোখের সামনে নেমে এল অন্ধকার ।
জ্ঞান ফিরতে নিজেকে দেখল হাসপাতালের একটা বেডে । সারা শরীরে ব্যথা । বা পাশে মাসী বসে । বিধ্বস্ত চোখমুখে । পায়ের তলায় একটু দূর থেকে একটা বড় ফোন দিয়ে সমানে ছবি তুলে চলেছেন একজন অল্প বয়সী ছেলে । দরজায় একজন মহিলা পুলিশ দাঁড়িয়ে ! নার্স কয়েক বেড পরে নিজের টেবিলে ছিলেন । তার জ্ঞান ফিরেছে দেখে প্রায় ছুটে এলেন ।
তারপর পুলিশের জেরা ! সাংবাদিকদের ফিসফাস । ব্যস্ত নার্স ডাক্তারদের ছোটাছুটি ও মাসীর করুণ মুখ !
চোখে জল এসে গিয়েছিল । মোছবার আগেই অনিকেতের হাতের রুমাল টা এগিয়ে এল । ওর হাত থেকে রুমাল টা প্রায় ছিনিয়ে নিয়ে সে ঝাঁঝিয়ে উঠল ,
— কেন , কেন তুমি আসো এখানে অনি ? আমি রাজী নই । কেন তুমি আমায় বইতে যাবে বল ? শেষে তো হাঁফিয়ে পড়বে । আমার জীবন তো শেষ , নিজেরটাও কেন শেষ করবে তুমি অনিকেত !
অনিকেত কৃত্রিম বিস্ময়ে বললে ,
— বাবাঃ কী রাগ ! আরে বাবা , তুমি তো হারবেই আমার কাছে শর্বি । তবে আজ এসেছি অন্য কাজে ।
শর্বানী শুধালে ,
— কী কাজে শুনি ?
অনিকেত একটা কাগজ বের করে মেলে ধরল তার দিকে ।
— উচ্চ মাধ্যমিকে তুমি জেলা টপার মিস শর্বানী মুখার্জী !
ঝাঁঝিয়ে উঠতে যেয়েও কেমন যেন হাবলে যেয়ে অনিকেতের মুখের দিকে চেয়ে সে বললে ,
— যাঃ !
Be the first to comment