তপন মল্লিক চৌধুরী
অ্যালবার্ট আইনস্টাইনের পর সেরা পদার্থবিদ হিসাবে বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয়তা পেলেও কাজের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি হিসেবে নোবেল পুরস্কার আর পাওয়া হয়নি স্টিফেন হকিংয়ের। তার আগেই চির বিদায় নিয়েছেন তিনি।
ব্রিটিশ এই পদার্থবিদ সবচেয়ে বেশি পরিচিত অপেক্ষবাদ ও ব্ল্যাক হোল বা কৃষ্ণগহ্বর নিয়ে তার তত্ত্বের জন্য। ‘এ ব্রিফ হিস্ট্রি অব টাইম’ এর মত বই লিখে তিনি বিজ্ঞানের জটিল বিষয়কেও সাধারণ মানুষের অনেক কাছাকাছি নিয়ে গেছেন। কাজ করেছেন মহাবিশ্বের জন্ম ও এর বিকাশ নিয়ে। অপেক্ষবাদ ও কোয়ান্টাম মেকানিক্সের সমন্বয়ে মহাবিশ্ব সৃষ্টি রহস্যের তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা দিয়ে বর্তমান সময়ের সেরা বিজ্ঞানীর স্থান দখল করেছিলেন স্টিফেন হকিং। সে হিসাবে তাকে নোবেল পুরস্কারের যোগ্য বললেও অত্যুক্তি হবে না।
তবে তার এ ব্যাখ্যা কেবল তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে হয়েছে। ব্ল্যাক হোল এবং বিগ ব্যাং নিয়ে তার তত্ত্বের ঠাঁই হয়েছে তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানে। কিন্তু বাস্তবে এর সত্যতা যাচাই করা যায়নি। তাই পরীক্ষার মাধ্যমে স্টিফেন হকিংয়ের তত্ত্বটির সত্যতা প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত তার নোবেল পুরস্কার পাওয়া সম্ভব ছিল না। বিজ্ঞান বিষয়ক মার্কিন লেখক এবং ‘দ্য সায়েন্স অব লিবার্টি’ গ্রন্থের রচয়িতা টিমোথি ফেরিসের মতে, আসলে হকিংয়ের তত্ত্বের সত্যতা যাচাইয়ের কোনো উপায় এখনো মানুষের জানা নেই। ব্ল্যাকহোল পর্যবেক্ষণ করা আজকের দিনে দূরূহ।
নোবেল পুরস্কারের নিয়মানুযায়ী, মানবজীবন বা মানবসেবায় কারো উল্লেখযোগ্য অবদান এবং পদার্থবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে কোনো যুগান্তকারী আবিষ্কার বা উদ্ভাবন পরীক্ষার মাধ্যমে প্রমাণের ভিত্তিতে সাধারণত পুরস্কারটি দেওয়া হয়। আর মরণোত্তর নোবেল পুরস্কার দেওয়ার নিয়ম নেই। হকিংয়ের তত্ত্বের সত্যতা যাচাইয়ের কোনো প্রযুক্তি এখনো মানুষের হাতে না থাকায় তার জীবদ্দশায় তা প্রমাণ করা যায়নি। তাই নোবেলও তার মেলেনি।
তবে অদূর ভবিষ্যতে মানুষ হকিংয়ের তত্ত্ব যাচাইয়ের পথ হয়ত খুঁজেও পেতে পারে। তখন এর সত্যতা হয়ত যাচাই করা সম্ভব হবে। কিন্তু মরণোত্তর নোবেলের নিয়ম না থাকায় তখনো হকিং সেই পুরস্কারের ভাগীদার হতে পারবেন না। ১৯৪২ সালের ৮ জানুয়ারি ইংল্যান্ডের অক্সফোর্ডে জন্ম নেন স্টিভেন উইলিয়াম হকিং। এই মহাবিশ্বের সৃষ্টি কীভাবে হয়েছে, তা অপেক্ষবাদ ও কোয়ান্টাম মেকানিক্সের সমন্বয়ে ব্যাখ্যা করেছেন তিনি নিজের তত্ত্বে।
কৃষ্ণগহ্বর থেকে শক্তি চুইয়ে বেরিয়ে যায় এবং এর ফলে কৃষ্ণগহ্বর একসময় হারিয়ে যায় বলে তিনি যে ধারণা দেন, তাই একসময় হকিং রেডিয়েশন নামে পরিচিতি পায়।
স্যার রজার পেনরোজের সঙ্গে করা যৌথ গবেষণায় তিনি দেখিয়েছিলেন, আইনস্টাইনের দেওয়া আপেক্ষিকতার সাধারণ সূত্রানুসারে স্থান-কালের শুরু বিগ ব্যাংয়ের মাধ্যমে এবং এর সমাপ্তি হয় কৃষ্ণগহ্বরে।
স্যার রজার পেনরোজের সঙ্গে করা যৌথ গবেষণায় তিনি দেখিয়েছিলেন, আইনস্টাইনের দেওয়া আপেক্ষিকতার সাধারণ সূত্রানুসারে স্থান-কালের শুরু বিগ ব্যাংয়ের মাধ্যমে এবং এর সমাপ্তি হয় কৃষ্ণগহ্বরে।
তাত্ত্বিক গবেষণার বাইরে এই বিজ্ঞানী সাধারণ মানুষের কাছেও জনপ্রিয় ছিলেন। তিনি একাধিক টেলিভিশন শোতেও হাজির হয়েছেন। এর মধ্যে রয়েছে ‘দ্য সিম্পসনস’, ‘রেড ডোয়ার্ফ’ ও ‘দ্য বিগ ব্যাং থিওরি’। এ ছাড়াও তাকে কেন্দ্র করেও তৈরি হয়েছে একাধিক টেলিভিশন অনুষ্ঠান ও সিনেমা।
‘Mind over matter’: Stephen Hawking – obituary by Roger Penrose
স্টিফেন হকিং—যিনি মারা গেলেন ৭৬ বছর বয়সে—তার মোটরচালিত হুইল চেয়ারে। মাথাটা একদিকে কাত আর হাত দুটো কন্ট্রোল প্যানেলে কাজ করার জন্য আড়াআড়ি রাখা—এমন ছবিই সাধারণ মানুষের কল্পনা ভাসে। এ যেন নিরেট বস্তুকে ছাপিয়ে মনের জয়োল্লাসের প্রতীক। প্রাচীন গ্রিসের দেলসির দৈববাণীতে যেমন যেন তেম্নিভাবেই শারীরিক অপূর্ণতা ও ত্রুটি উসুল হয়ে গেছে প্রায় অতিলৌকিক এক ক্ষমতার বরে। যা বদৌলতে মুক্ত স্বাধীন মন তার ঘুরে বেড়িয়েছে গোটা ব্রহ্মাণ্ডজুড়ে। আর হঠাৎই হঠাৎই ব্রহ্মাণ্ডের নানা গোপনকে তিনি হাজির করতেন, যেসব গোপন লুকানো থাকতো লোকচক্ষুর আড়ালে।
এভাবে লেখা শুরু করেন পেনরোজ। এরপর তিনি লেখেন:
অবশ্যই এমন ভাবালুতাময় ছবিও তাকে তুলে ধরে বটে, তবে তাতে তার আংশিক পরিচয়ই ফুটে ওঠে। যারা হকিংকে চেনেন, তারাই একজন সত্যিকারের মানুষ হিসেবে তার প্রবল উপস্থিতির গুণকীর্তন করতে পারবেন। এমন এক মানুষ যার ছিল জীবনের প্রতি ছিল তার অসীম উচ্ছ্বাস, ছিল রসিক এক মন আর সেইসঙ্গে বিপুল দৃঢ় মনোবল। ছিল প্রবল মানসিক শক্তির পাশাপাশি মানবিক দুর্বলতাও। আর দশটা স্বাভাবিক সাধারণ মানুষের মতোই।
সাধারণ মানুষের মধ্যে “the No 1 celebrity scientist” বলে তাকে নিয়ে যে ধারণা গড়ে উঠেছিল, তাতে খুব মজা পেতেন তিনি। তিনি কোথাও বক্তৃতা দিতে গেলে সেখানে বিপুল মানুষের উপস্থিতি ঘটতো ; সেটা যে বৈজ্ঞানিক কারণেই হতো, সম্ভবত ব্যাপারটা সব সময় এমন ছিল না।
Be the first to comment