গল্প – স্টিফেন হকিং ও ইউরেকা মুমেন্টস

Spread the love

দীপক আঢ্য-

স্টিফেন হকিং এর মৃত্যুর খবর শোনার পরই আমার সবার আগে যার কথা মনে পড়ল সে আর কেউ না, আমাদের বিকাশজ্যেঠু। অর্থাৎ বিজ্ঞানী বিকাশ সিনহা। যার ঝুলিতে ইতিমধ্যেই পদ্মশ্রী, পদ্মভূষণ ছাড়াও আছে আরও কত কী। এত বড় মাপের মানুষটা যে কত সাধারণ আর মাটির কাছে থাকতে পারে তা বিকাশজ্যেঠুকে না জানলে না চিনলে আমরা কেউ ভাবতেই পারতাম না।

প্রকৃতপক্ষে হকিং সম্পর্কে যে ছোটখাটো একটুআধটু গল্প আমরা কমবেশি সকলে জানি তা আমাদের এই বিকাশজ্যেঠুর কাছ থেকেই শোনা। তাই আজ কেমন যেন মনে হচ্ছিল বিকাশজ্যেঠু কাছে থাকলে নিশ্চয়ই আড্ডাটা জমত ভারী।

সতুদার চা’র দোকানের অন্ধকার কোনায় আমরা তিন-চার জন। তক্তপোষে বসে মৌজ করে সিগারেট টানছিল তন্ময়। হঠাৎ সুরেশ সোৎসাহে বলে উঠল , ওই দেখ বিকাশ জ্যেঠু। এদিকেই আসছে। আমি ঘাড় কাত করে দেখলাম হ্যাঁ, তাইতো। প্রায় বছর খানিক পরে দেখছি। আগের মতোই হাসিহাসি মুখ। মাথা ভর্তি সাদা চুল। একটা অতি সাদামাটা পাজামা পাঞ্জাবি পরা। বাইরে থেকে দেখে বোঝার উপায় নেই যে এই সাধারণ মানুষটাই মুর্শিদাবাদের কান্দির জমিদার বংশের উজ্জ্বল পুরুষ। জ্যেঠুকে দেখে আমাদের মনের ভিতরটা মুহূর্তে যেন খুশিতে মিষ্টি হয়ে উঠল। আতান্তরে পড়ল তন্ময়। ওর হাতে জ্বলন্ত সিগারেট। না পারছে ধোঁয়া আটকাতে না পারছে ফেলতে।

জ্যেঠু চায়ের দোকানের ভিতর ঢুকেই আমাদের সকলকে এক সাথে দেখে বলল, তোরা আছিস তাহলে। আমি আরও আসতে আসতে ভাবছিলাম, অ্যাদ্দিন পরে যাচ্ছি। যদি সতুর দোকানে তোদের সাথে দেখা না হয়, তাহলে বড্ড মন খারাপ লাগবে ক’টা দিন। তন্ময়ের দিকে তাকিয়ে বলল, আরে বড় হয়েছিস। ভালোমন্দ সব বুঝিস, তা সিগারেটটা যখন ধরিয়েই ফেলেছিস, টান। অকারণে পুড়িয়ে কী লাভ বল? পরে তা না হলে মনেমনে আমাকেই গাল পাড়বি।

বিকাশজ্যেঠুর কথা শুনতে শুনতে কান-মুখ লাল তন্ময়ের। পরিস্থিতি লঘু করতে কথা ঘোরাল সুরেশ। কবে আসলেন জ্যেঠু? আমিও বেশ উৎসাহ নিয়ে বললাম, এই তোমার কথাই হচ্ছিল। তুমি আর হকিং…

–চা খাবি তো নিশ্চই? এই সতু, আমাদের সবাইকে চা আর কটকটি ভাজা দে। কদ্দিন খাইনি। বিকাশজ্যেঠুর সহাস্য অর্ডার।

দু’চারটে ছেঁদো কথা পার হতেই কথা প্রসঙ্গে আবারও স্টিফেন হকিং। আমি আবারও বললাম, আজকের দিনে তুমি দিল্লী বা কোলকাতায় থাকলে তো তোমাকে টিভির বাইটে দেখতাম। তার থেকে তুমি যখন সামনাসামনি আছো, তখন নতুন কোন গল্প বলনা হকিং সম্পর্কে।

জ্যেঠু আমাদের সকলকে একবার যেন চোখ দিয়ে মেপে নিল। তারপর স্বগতোক্তির মতো বলল, হ্যাঁ, বলাই যায়। তোদের সবারই তো এখন কলেজ তাই না?

আমরা সমবেতভাবে হ্যাঁ বলতেই জ্যেঠু কয়েক সেকেণ্ড যেন কী ভেবে নিল, তারপর বলতে শুরু করল, সে এক দারুণ ঘটনা। আমার স্মৃতিতে একদম টাটকা!

আমরা সকলে গা ঝাড়া দিয়ে গুছিয়ে বসলাম।

জ্যেঠু বলতে লাগল, আমার জন্ম আর ক্লাস বরাবরই স্টিফেনের থেকে তিন বছর পিছিয়ে। ওনার জন্ম ১৯৪২ আর আমার ১৯৪৫। আমি যখন কেম্ব্রিজে আণ্ডার গ্রাজুয়েট তখন ওঁর গ্রাজুয়েশন শেষ। কাজ করছেন ফ্রেড হয়েলের সাথে। এই ফ্রেড হয়েল ভদ্রলোকটি কখনো বিগ ব্যাং এর অস্তিত্বই স্বীকার করেননি। যদিও এঁরা দু’জন মিলেই কিন্তু এই বিগ ব্যাং শব্দটা সৃষ্টি করেন।

যখন স্টিফেন তাঁর হকিং রেডিয়েশণ আবিষ্কার করেন, তখন কিন্তু তিনি নিজেই বেশ কুণ্ঠিত – বলা ভালো, অ্যামব্যারাসড্‌ কারণ তখন আমাদের সকলের ধারণা এই ব্লাক হোল সব কিছুকেই গ্রাস করে নেয় যা তার সীমার মধ্যে আসে। কোন কিছুকেই ছাড়ে না। সর্বভুক। কিন্তু স্টিফেন বললেন,না। এই ধারণা ভুল। যদিও এটা হঠাৎ ভাবনা নয় তবুও…

ঘটনাটা ঠিক কী ছিল জানিস? আসলে স্টিফেন ছিলেন মানসিক ভাবে চির তরুণ। মানসিক উচ্ছ্বলতা ওঁর জীবন থেকে কখনো হারায় নি। জ্যেঠু বলতে লাগল, সে রাত ছিল ওঁর কাছে একটা খুব রোমান্টিক রাত। অন্ধকার গভীর হয়েছে। মাঝ রাত পার করে উনি শুতে যাচ্ছেন বিছানায়। ঠিক এই সময় উনি উপলব্ধি করলেন, ওঁনার পরিভাষায় ‘ইউরেকা মুমেন্টস’। নিজের কাছে নিশ্চিত হন কৃষ্ণ গহ্বর সকল কিছুকে কেবল মাত্র গ্রহণ করে তাই নয়, কিছু রেডিয়েশণ ফিরিয়েও দেয়। এটাই তাঁর যুগান্তকারী থিওরি ‘হকিং রেডিয়েশণ’।

এতটা বলে একটু থামল জ্যেঠু। আমার দিকে তাকিয়ে বলল, বুঝলি কিছু?

আমি আমতাআমতা করে বললাম, হ্যাঁ। তবে ওই ‘ইউরেকা মুমেন্টস’ ঠিক যেন মাথায় ঢুকলনা।

জ্যেঠু একটু মিচকে হেসে বলল, ও-ও-ও, এইটুকু? বলেই আমার কাঁধে হাত রাখল। প্রেম-ট্রেম করিস? ঝাড়ি মারিস?

জ্যেঠুর হঠাৎ এহেন প্রশ্নে আমি একদম ভ্যাবাচাকা। কী বলব বুঝে উঠতে পারলাম না। মুহূর্তে তন্ময় , সুরেশ ওরাও যেন স্পেডের টেক্কা হাতে পেয়েছে। তন্ময় বেশ জোরের সাথেই বলল, হ্যাঁ, হ্যাঁ। আর সে তো ডুবেডুবে না, একদম ভেসেভেসে। সুরেশ বলল, বলনা, সুহৃদার কথা। জ্যেঠু জানতে পারলে লাইন দেখবি পরিষ্কার হয়ে যাবে। আমি সকলের সাঁড়াশি আক্রমণের ফলে বাধ্য হয়ে বললাম, তুমি ছাড়োই না ওদের কথা। সহজ করে বললে তো এমনিই বুঝবো।

হুম্‌। তাহলে সহজ করেই বলি, জ্যেঠু বলল। সুরেশের দিকে তাকিয়ে বলল। কী নাম বললি?

–সুহৃদা।

–বাহ্‌! বেশ খাশা নাম তো! তা মনে কর , আমার দিকেই জ্যেঠুর চোখ – সেই প্রথম যেদিন তুই সুহৃদাকে দেখলি দূর থেকে সে আসছে কিম্বা মনে কর তোর দেওয়া প্রপোস স্বীকার করেছে, তারপর তোর সাথে প্রথম দেখা করতে আসছে – ঠিক সে সময় বুকের মধ্যে উথালপাতাল, কেমন রিনিঝিনি সুর বাজছে কানে – কাটফাটা রোদ্দুরেও তোর মনে হচ্ছে বসন্ত, কাকের ডাকও কি সুন্দর মিষ্টি – সেই মুহূর্তই হ’ল এই ‘ইউরেকা মুমেন্টস’।

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*