পায়েল খাঁড়া
মুখ ভার থাকতে থাকতে দুপুর থেকে অঝোর বৃষ্টি নেমেছে।জানালায় ঠেস দিয়ে সিগারেট টানছিল ইমন।মেঘের কালি মেখে আকাশটা কুৎশিত হয়ে আছে।একটা কালো মার্সেডিজ সশব্দে সামনে রাস্তা দিয়ে বেরিয়ে গেল।ব্যাকলাইটের আলোয় প্রজেক্টরের মত কতকগুলো দৃশ্যপট ভেসে উঠল ওর মানসচোখে।
প্রায় বছর পনের আগের কথা।উঠতি বয়সে সিনেমার নেশায় পেয়েছিল ইমনকে। রেগুলার সুটিং পাড়ায় যেত সে অবশ্য অ্যাক্টিংএর চেয়েও বেশি অন্য একটা কারন টানত তাকে মুহুর্মুহু!সিনেমার এক অভিনেত্রী শ্রীলেখার তখন বিস্তর নাম-ডাক। আহামরি রূপসী তাকে বলা যায় না তবে তার ভঙ্গিমার সুক্ষ্ম আবেদন নিমেষে ঘায়েল করত দর্শককুলকে।
এই শ্রীলেখা’কে দেখার জন্যই সুটিং পাড়ায় ছুটে যেত ইমন।ঘন্টার পর ঘন্টা তার ভ্যানিটির সামনে দাঁড়িয়ে থাকত।মুগ্ধচোখে দেখত তাকে কিন্তু এগিয়ে এসে কথা বলার সাহস জোগাতো না।শ্রীলেখাও অনেকদিন ধরেই লক্ষ্য করেছিল ব্যাপারটা।সে তিরিশোর্ধ বলিষ্ঠ অভিনেত্রী__তার অগুন্তি ভক্ত তবু ইমনের ওই তরুণ মাদকতা দাগ কেটেছিল তার মনে।ইমনকে দেখলেই একটা অবান্তর উত্তেজনায় শিহরিয়ে উঠত শ্রীলেখাও কিন্তু মুখে বলত না কিছুই।
এইভাবেই শহরের সরগরম জনশোরের অলিন্দে সবার অগোচরে নৈশাব্দিক তরঙ্গমালায় একটু করে বেড়ে চলেছিল একটা অসম সম্পর্কের উষ্ণতা।আর ঠিক তখনই একটা অপ্রত্যাশিত সুযোগ এল ইমনের জীবনে।
ফিল্মে শ্রীলেখার এক প্রিয়পাত্রের চরিত্রের জন্য ডাইরেকটর ইমনকে অ্যাপ্রোচ করলেন। বাকি গ্রুপের সঙ্গে আলাপটা তার ভালোই জমেছিল কিন্তু শ্রীলেখাকে দেখলেই সে খেই হারিয়ে ফেলত।সিনেমার সংলাপ ছাড়া ওদের বিশেষ একটা কথাও হত না।
সুটিং তখন প্রায় শেষ, একদিন নিজের গ্রীনরুমে ইমনকে ডেকে পাঠালো শ্রীলেখা। দুরুদুরু বুকে দরজায় এসে টোকা দিতেই উত্তর এল “ভিতরে এস”, একটা চেয়ার দেখিয়ে বলল, “বোসো ইমন”
ইমনের উদ্ভাসিত অকপট মুখশ্রীর দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে স্মিতমুখে শ্রীলেখা বলল, “অনেকদিন ধরেই একটা কথা তোমায় বলব ভাবছিলাম কিন্ত তোমার সীনগুলো শেষ হওয়ার আগে বলাটা হয়ত ঠিক হত না, তাই__।আচ্ছা তুমি জানো আমি তোমার চেয়ে দশ বছরের বড়?”
ইমন ঘাড় নেড়ে সায় দিল।আবার বলতে শুরু করল শ্রীলেখা,
“এই সিনেমার জগৎটা পর্দার অভিনয়গুলোর মতই ফেক ইমন, কোনো বাস্তব ভিত এর নেই।কত জীবন তলিয়ে গেছে এর চোরাবালিতে__সফলতাটাও তাৎক্ষনিক ভ্রম। নাম-যশ-অর্থ-ফ্যানস’দের ভালোবাসা সবই মেলে কিন্তু তার দাম চুকাতে হয় অনেক বেশি।আমি জানি তুমি আমার প্রতি আকৃষ্ট।সত্যি বলতে আমারও তোমাকে ভীষন ভালো লেগে গেছে আর তাই বলছি,ইমন চলে যাও এই জগৎ থেকে।এ জায়গা তোমার জন্য নয়।”
“আপনি কি আমায় একটুও ভালোবাসেন না?”বোকার মত প্রশ্নটা করে বসল ইমন
তার সরল মুখের উপর একটা গাঢ় দৃষ্টি ফেলে নরম সুরে শ্রীলেখা বলল, “ভালোবাসি, তাই তো ফিরিয়ে দিচ্ছি!”
কলিংবেলের শব্দে স্মৃতির ঘোর কাটল ইমনের।বৃষ্টিটা ধরে এসেছে।দরজা খুলতেই ভিজে বর্ষাতি গায়ে তাকে জড়িয়ে ধরল তার চার বছরের মেয়ে শ্রীলেখা।
Be the first to comment