পিয়ালী ।।
সুচেতা কৃপালিনী, ভারতের প্রথম মহিলা মুখ্যমন্ত্রী। উত্তরপ্রদেশের মতো বড়ো বৈচিত্রপূর্ণ রাজ্যের দায়িত্ব সামলেছেন। মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন ১৯৬৩ থেকে ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত। আজ তাঁর জন্মদিন। ১৯০৮ সালের ২৫ জুন জন্ম হয় তাঁর। অনেকেই হয়ত জানেন যে, তিনি বঙ্গতনয়া। তাঁর আসল নাম সুচেতা মজুমদার। জন্ম যদিও প্রবাসে। পাঞ্জাবের আম্বালা (অধুনা হরিয়ানা) বাঙালি ব্রাহ্ম পরিবারে জন্ম তাঁর। বাবা সুরেন্দ্রনাথ মজুমদার ছিলেন মেডিকেল অফিসার। দেশের বিভিন্ন জায়গায় পোস্টিং হত তাঁর। ছোট সুচেতাও বাবা তথা পরিবারের সঙ্গে এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় গেছেন, বিভিন্ন স্কুলে পড়েছেন। তবে দিল্লির সেন্ট স্টিফেনস কলেজ থেকে ইতিহাসে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। ছোটোবেলায় তিনি খানিকটা লাজুক প্রকৃতির ছিলেন। কিন্তু পরবর্তীতে দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে আত্মনিয়োগ করেন। তাঁর সম্পর্কে মহাত্মা গান্ধি বলেন, A person of rare courage and character who brought credit to Indian womenhood. সংবিধান রচনায় যে সাব কমিটি, তাতেও তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। ১৪ আগস্ট ১৯৪৭ স্বাধীনতার নতুন সূর্য যখন ওঠে, তখন সেই আসরে বন্দেমাতরম পরিবেশন করেন। যখন নেহরু তাঁর বিখ্যাত ‘Tryst with destiny’ বক্তব্য রাখছিলেন, সেই প্রাক্কালে তিনি সেখানে বন্দেমাতরম পরিবেশন করেন। ১৯৪০ সালে অল ইন্ডিয়া মহিলা কংগ্রেস-এর সূচনালগ্নে তিনি ছিলেন অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনের অগ্রণীদের মধ্যে অরুণা আসফ আলি, উষা মেহেতা-দের সঙ্গে সুচেতাও কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করেন। দেশভাগজনিত দাঙ্গায় গান্ধিজির সহকর্মী ছিলেন তিনি। ১৯৪৬-এর নোয়াখালি দাঙ্গায় গান্ধিজির পাশে দাঁড়িয়ে বিশেষ ভূমিকা রাখেন তিনি। এ তো গেল স্বাধীনতার আগের কথা। স্বাধীনতার পরে ১৯৫২ সালে প্রথম লোকসভা নির্বাচনে নিউ দিল্লি থেকে কেএমপিপি-এর টিকিটে তিনি হারিয়েছিলেন কংগ্রেস প্রার্থী মনমোহিনী সায়গল-কে। পাঁচ বছর পরে আবার তিনি পুননির্বাচিত হন। যদিও সেটি কংগ্রেস প্রার্থী হিসেবে। ইতিমধ্যে তিনি কংগ্রেসে যোগদান করেছেন। তাঁর স্বামী জে বি কৃপালিনী ছিলেন নামকরা কংগ্রেস নেতা। সুচেতার থেকে তাঁর স্বামী কুড়ি বছরের বড় হওয়ায় এ বিয়েতে মত ছিল না স্বয়ং গান্ধিজি-সহ পরিবারের। অবিভক্ত উত্তরপ্রদেশের ১৯৬০ থেকে ১৯৬৩ বিধায়ক ছিলেন তিনি। ১৯৬৩-তে মুখ্যমন্ত্রী হন উত্তরপ্রদেশের। ভারতের আগে তার আগে কোনও অঙ্গরাজ্যে কোনও মহিলা মুখ্যমন্ত্রী ছিল না। তিনি মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পরই উত্তরপ্রদেশের সরকারি কর্মীরা ৬২ দিনের স্ট্রাইক করেন। অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে বেতনবৃদ্ধি না করে তিনি এই স্ট্রাইক সামলান। ১৯৬৯ সালে কংগ্রেস ভাগ হলে মোরারজি দেশাইয়ের এনসিও-তে যোগদান করেন তিনি। ১৯৭১-এ নির্বাচনে পরাজিত হন। ১৯৭৪ সালে দেহ রাখেন তিনি। আজ তাঁর জন্মদিনে আরও একজন বাঙালি মুখ্যমন্ত্রীর কথা বড়ো মনে পড়ে। তিনি হলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সুচেতা কৃপালিনীর মত মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও নারী ক্ষমতায়নের এক উজ্জ্বল মুখ। মমতা সুচেতার মত উচ্চবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেননি। দক্ষিণ কলকাতার কালীঘাটে ছোট্ট টালির চালের বাসিন্দা। জন্ম থেকে আজ ইস্তক পায়ে হাওয়াই চটি সাধারণ পোশাক। তাঁর পরিবার বলতে তিনি বোঝেন তৃণমূল কংগ্রেস পরিবার। সুচেতার মত মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও ইতিহাস নিয়ে স্নাতকোত্তর করেন। তাঁদের মধ্যে আরও মিল হল একজন দেশের প্রথম মহিলা মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন, আর একজন আপাতত সারা দেশের মধ্যে একমাত্র মহিলা মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে হ্যাট্রিকও করেছেন মমতা। সুচেতা-মমতা দুজনেই কড়া প্রশাসক। কন্যাশ্রী, রূপশ্রী, স্বাস্থ্যসাথী, দুয়ারে সরকার একাধিক প্রকল্প করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে তাঁর মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন। এই দুই বঙ্গতনয়া তাঁদের ভূমিকার জন্য রাজ্য তথা দেশে নারী ক্ষমতায়তনের দুই অন্যতম মুখ হিসেবে পরিগণিত হন। আজ সুচেতার জন্মদিনে পাঠকদের জানানো হচ্ছে, আমাদের দেশে মহিলা মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন মোট ১৬ জন। সুচেতার জন্মদিনে তাঁদের নাম উল্লেখ করে নারী ক্ষমতায়নের বার্তা দিতে চাই আমরা। প্রথম সুচেতা কৃপালিনী, তারপর ওড়িশার নন্দিনী শতপথী, গোয়ার শশীকলা কাকোদকর, অসমের আনোয়ারা তৈমুর, তামিলনাড়ুর ভি এন রামাচন্দ্রণ, জে জয়ললিতা, উত্তরপ্রদেশে মায়াবতী, পাঞ্জাবের রাজীন্দ্রর কাউর ভট্টল, বিহারে রাবড়ি দেবী, দিল্লি, সুষমা স্বরাজ, শীলা দিক্ষিত (তিন বার), মধ্যপ্রদেশে উমা ভারতী, রাজস্থানে বসুন্ধরা রাজে, পশ্চিমবঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, গুজরাটে আনন্দীবেন প্যাটেল, জম্মু ও কাশ্মীরে মেহবুবা মুফতী। সুচেতা যে চেতনার রাস্তা দেখিয়েছিলেন, সেই সোনালী পথ ধরেই এই ১৬ জন মুখ্যমন্ত্রী উল্লেখযোগ্য ভূমিকার স্বাক্ষর রাখেন। বাংলা তথা দেশের মেয়েদের কাছে তাই আজকের দিনটি অন্যতম দৃষ্টান্ত হিসেবে পরিগণিত হোক।
Be the first to comment