ভাস্কর ঘোষাল
পঞ্চাশের দশকের শুরুর দিক। ব্যস্ত টালিগঞ্জ স্টুডিও পাড়া। ফ্লোরে ফ্লোরে চলছে বিভিন্ন সিনেমার শ্যুটিং। সব ফ্লোর থেকে বাইরে ভেসে আসছে একই আওয়াজ। সাউন্ড, লাইট, ক্যামেরা— রোলিং। এরইমধ্যে আবার অনেক শিল্পী বাইরে ইতস্তত ঘোরাঘুরি করছেন বা বসে রয়েছেন, পরবর্তী সিন শ্যুটের অপেক্ষায়। অনেকটা আর পাঁচটা দিনের মতন।
দুপুর গড়িয়ে আসছে। লাঞ্চ ব্রেকের পথে শিল্পী মন। এমন সময় স্টুডিওর গেট দিয়ে গাড়ি ঢুকে এসে দাড়াল একটা বট গাছের সামনে। বাইরে থাকা শিল্পীরা তেমন আমল দিলেন না, ভাবলেন এরকম তো রোজ কত লোক আসে। তাঁদের সেদিনের ভাবনায় যে ভুল ছিল, তা পরবর্তী কালে নতমস্তকে মেনে নিয়েছিল বলব না, মানতে বাধ্য হয়েছিল টালিগঞ্জ স্টুডিও পাড়া।
পরের দু’দশক ধরে তিনি ছিলেন সম্রাজ্ঞী। শুধু টালিগঞ্জ নয় বম্বে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে পর্যন্ত কাজ করেছেন নিজের ডিকটেশনে। আলাদা করে নাম বলার প্রয়োজন নেই। পাঠক মাত্রই বুঝতে পারছেন কার কথা বলা হচ্ছে। লেখার নিয়ম মানার তাগিদে নাম লিখতে হয় বলে উল্লেখ করলাম — তিনি আর কেউ নন, সুচিত্রা সেন।
স্টুডিও পাড়ায় মিসেস সেন বা ম্যাডাম সেন-ই ছিল তাঁর একমাত্র পরিচয়। প্রথম দিন সিনেমায় কাজ করতে এসেছিলেন স্বামী দিবানাথ সেনের সঙ্গে। ১৯৫২ সালে ‘শেষ কোথায় ছবি-র মাধ্যমে তাঁর চলচ্চিত্র জীবনের যাত্রা শুরু হয়। দুর্ভাগ্যক্রমে শেষ পর্যন্ত চলচ্চিত্রটি মুক্তির আলো দেখে না। এই ছবিতে তাঁর রমা নাম পরিবর্তন করে ‘সুচিত্রা’ রাখা হয়।
১৯৫৩ সালে সুচিত্রা সেনের মুক্তিপ্রাপ্ত প্রথম ছবি ‘সাড়ে চুয়াত্তুর’। নায়ক হিসেবে অভিনয় করেন উত্তম কুমার। ২৫ বছরের অভিনেত্রী জীবনে অভিনয় করেছেন মাত্র ৫৩টি বাংলা সিনেমায়। তেমন ভাবে বহুমুখী চরিত্রে তাঁকে অভিনয় করতেও দেখা যায়নি। প্রায় এক ধরণের রোম্যান্টিক চরিত্রেই তাঁকে অভিনয় করতে দেখেছে বাঙালি।
শুরুর দিন থেকেই বুঝিয়ে দিয়েছিলেন অন্য আরও পাঁচ শিল্পীর থেকে তিনি আলাদা। তাঁর ব্যাক্তিত্বের দাপটে নতিস্বীকার করতে বাধ্য হয়েছিল ইন্ডাস্ট্রি। যেমন মাথা নীচু করেছিল ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ সিনেমায় অন্য বোর্ডাররা। এই সিনেমার মধ্য দিয়েই যাত্রা শুরু হয় সুচিত্রা -উত্তম জুটি। সেই সময় সুচিত্রা সেনের নাম আগে রাখা হত। কারণ অভিনয় ও জনপ্রিয়তায় উত্তমকুমারের তুলনায় অনেকটা এগিয়ে ছিলেন তিনি। তখন ধীরে ধীরে উত্তমকুমার আয়ত্ত করছেন সিনেমায় অভিনয়ের কলা-কৌশল৷ সুচিত্রার বিপরীতের উত্তমকুমার কিন্ত্ত পরিণত উত্তমকুমার নয়, এমনকী চরিত্রাভিনেতা উত্তমকুমারও নয়৷ মধ্য পঞ্চাশের দশকের শিক্ষানবীশ উত্তমকুমার৷
সেই উত্তমকুমারের সঙ্গে ‘অগ্নিপরীক্ষা’, ‘সবার উপরে’, ‘হারানো সুর’, ‘চাওয়া পাওয়া’ আর ‘সপ্তপদী’র মতো ছবিতে অভিনয় করেই বাংলা সিনেমার সেরা রোম্যান্টিক জুটির জন্ম৷ এই রোম্যান্টিক রসায়নে কার অবদান বেশি সে নিয়ে তর্ক থাকতে পারে৷ কিন্ত্ত উত্তমকুমার নিজে স্বীকার করেছিলেন সুচিত্রা না থাকলে উত্তমকুমারের জন্ম হত না৷ শোনা যায় যে, উত্তমকুমার পর্যন্ত মেনে নিয়েছেন তাঁদের জুটির নাম উত্তম-সুচিত্রা নয়, সুচিত্রা-উত্তম৷
পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় তাঁর ছিল নিঃশব্দ প্রতিবাদ। সিনেমায় নায়ক নয়, নায়িকাই হবে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। মহিলা শিল্পী মানেই তাঁর নিজের মতামত থাকবে না, মেনে চলতে হবে সকলের কথা,বরদাস্ত করেননি কোনও দিনও। পরবর্তী কালে তিনি হয়ে উঠেছিলেন প্রতিবাদের মুখ। আবার এই কাজের জন্য তাঁকে স্ট্রিট ফাইটার হতে হয়নি। নিজের শারীরিক ভাষায় ভর করেই পৌঁছে গিয়েছিলেন ওই পর্যায়ে।
তখনকার দিনে জনপ্রিয় সিনেমা-পত্রিকা ছিল ‘রূপমঞ্চ’। সম্পাদক কালীশ মুখোপাধ্যায় তাঁর পত্রিকায় ‘ফটো-ফিচার’-এর জন্য হাতিবাগানে নিজস্ব স্টুডিয়োতে এসে ছবি তোলার আমন্ত্রণ জানিয়ে ছিলেন সুচিত্রা সেনকে। উত্তরে বলেন, তিনি যেতে পারবেন না, ছবি যদি তুলতে হয়, তাঁর সুবিধে মতো জায়গায় কালীশবাবুকে আসতে হবে৷ সুচিত্রা এই কথা বলেছিলেন, যখন তাঁর মাত্র একটি ছবি (‘সাত নম্বর কয়েদী’) মুক্তি পেয়েছে! আসলে প্রথম দিন থেকে তিনি ছিলেন মিসেস সেন বা ম্যাডাম সেন।
১৯৬১ সালে সত্যজিত্ রায় ‘দেবী চৌধুরাণী’ সিনেমা করবেন বলে মনস্থির করেছিলেন। নাম ভূমিকায় অভিনয় করার জন্য সুচিত্রা সেনকে অনুরোধ করেন। অভিনয় করতে অস্বীকার করেন মিসেস সেন। তাঁর মনে হয়েছিল ‘অপু ট্রিলজি’-র পরিচালকের ছবিতে তিনি হয়ে উঠবেন ‘পাপেট’ মাত্র৷ টালিগঞ্জের ‘ম্যাডাম’ স্টেটাসে তাতে টোল পড়তে পারে৷ তিনি ভুল কি ঠিক ছিলেন তা নিয়ে তর্ক হতে পারে, তবে নিজের সিদ্ধান্তে তিনি যে অবিচল ছিলেন তাতে কোনও সন্দেহ নেই৷
ব্যাক্তিত্ব ছিল চোখে পড়ার মতন। তাঁর সামনে তটস্থ গোটা স্টুডিও। সিনেমার পর্দায় বা বাস্তব জীবনে দুই ক্ষেত্রেই ছিল সমান দাপট। দৃষ্টির মধ্য দিয়ে সিনেমা প্রেমিক দর্শক মনকে বিদ্ধ করেছিলেন তিনি। তাঁর চলাফেরায় ছিল আভিজাত্যের ছাপ। সিনেমায় রিনা ব্রাউন যখন বাইকে করে যাওয়ার সময় ভালোবাসার আবেগে কৃষ্ণেন্দুর পিঠে মুখের আলতো ছোঁয়ায় বলে ‘তুমি’ — দর্শক মনেও তার অনুরণন ঘটে।
নায়িকা-সংবাদ নয়, দেখলেই মনে হয় কোনও ঘরোয়া প্রেমিক, কটাক্ষে মায়াবী নেশা, ঠোঁটে লেগে থাকে কবেকার যেন ভেজা অভিমান, সাদা-কালো রঙে পর্দা জুড়ে ভেসে ওঠে সেই ব্যাক্তিত্ব। নিশিরাত, যৌবন, হারানো-সুরের স্বর ঠোঁটে নিয়ে উড়ে আসে রুপোলি মধুর মৌমাছি। প্রেমে প’ড়ে গোটা জাতি। বাঁকা চাঁদে কত প্রেম ছিল তবে ? হালকা-আধো স্বরলিপি, চিরযুবতীর নির্বাসনে কী কথা যে বলতে চায়। রোম্যান্স জেগে থাকে, অনেকটা যামিকা যেমন জানে, আলো আছে আঁধার-গোপনে।
Be the first to comment